পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলতে হলে প্রথমেই যেটা বলতে হয়, সে দেশে যা হয় তা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’। সে কর্তারা হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা বলতে গেলে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই রাজনীতির কলকাঠি চালিয়ে এসেছেন, হয় প্রত্যক্ষভাবে না হয় পরোক্ষভাবে।
পাকিস্তানের রাজনীতির এই ‘পুরনো খেলা’ নিয়ে তাই নতুন করে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু দেশটির রাজনীতির এক ‘জাদুকর’ আসিফ আলী জারদারির পুনরায় নাট্যমঞ্চে আবার প্রবেশ দেখে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে।
তিনি পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নাটকের এক ‘নাটগুরু’ হয়ে আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখনকার নিয়মে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি আলংকারিক পদ, তবুও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। জারদারির উত্থান–পতন আর পুনরাবির্ভাব শুধু পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘অদৃশ্য হাতের’ কথাই বলে না, পাকিস্তান কীভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি– সে কথাও বলে।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আততায়ীর হাতে মৃত্যু হয়। সেই সময় থেকে দেশটির সেনাবাহিনী পেছন থেকে পাকিস্তানের শাসনভার চালিয়ে আসছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও তার হাত আজও কঠিনভাবে দেশটির গলা টিপে আছে। গত সাত দশকের মধ্যে একটা বড় সময়ই পাকিস্তান সেনাশাসনের অধীনে ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা অর্থাৎ সেনাপ্রধান প্রত্যক্ষভাবে দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে মোটামুটি পাকিস্তানের অর্ধেক জীবন পার করেছে।
শুরু হয় আইয়ুব খান দিয়ে ১৯৫৮ সালে আর শেষ হয় ২০০৮ সালে পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালে প্রথম সামরিক আইন জারি করে নিজে শাসন হাতে নেন। দুই বছর পর নির্বাচন দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে পরোক্ষভাবে সামরিক শক্তি দিয়েই দেশ শাসন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
পারভেজ মোশাররফের পতন একভাবে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ শাসনভার থেকে আপাতভাবে সরালেও রাজনীতি থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির অদৃশ্য হাত সরে যায়নি। পারভেজ মোশাররফের শাসনকালেই আসিফ আলী জারদারির স্ত্রী বেনজির ভুট্টো (যিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) পাকিস্তানে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে বোমা হামলায় বেনজির নিহত হন। বেনজিরের মৃত্যুর পর জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেননি। কৌশলগত কারণে নিজে না হয়ে তাঁর ১৯ বছর বয়সী ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টোকে তিনি পিপিপির চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। তাঁর দল তা গ্রহণ করে।
কীভাবে আসিফ আলী জারদারি তাঁর দল পিপিপির ওপর বিপুল ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তার করেন, এটা ছিল তার একটা বিরাট প্রমাণ। অথচ বেনজির ভুট্টোকে বিয়ে করার আগে এ দলের ওপর তাঁর কোনো প্রভাব থাকা তো দূরের কথা, তিনি এ দলের কোনো উল্লেখযোগ্য সদস্যও ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের এক প্রখ্যাত জমিদারের পুত্র, অগাধ সম্পদের উত্তরাধিকারী। তিনি লন্ডনে লেখাপড়া করেছেন এবং বয়সে বেনজিরের চেয়ে দুই বছরের ছোট।
সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়, এ বিয়ে প্রেমের বিয়ে ছিল না। আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে এ বিয়ে হয়েছিল। বেনজির যে এ রকম এক ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন, তা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এক অভাবনীয় ছিল। বেনজির শুধু জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়েই নন, তিনি হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করেছেন। এরপর ফাঁসিকাষ্ঠে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মা নুসরাতের সঙ্গে পিপিপির হাল ধরেন।
এ রকম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আসিফ জারদারির মতো প্রায় অখ্যাত ব্যক্তিকে কেন বিয়ে করবেন, তা নিয়ে পাকিস্তানে বেশ গুঞ্জন হয়। কিন্তু বেনজির এ আলাপের বিয়েতে সহজেই রাজি হন, কারণ জারদারি দেখতে ভালোই ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আর বিয়ের সময় বেনজিরের সঙ্গে এ চুক্তি হয় যে তিনি রাজনীতি করবেন না। বেনজিরেরও তখন একটি বিয়ে হওয়া জরুরি ছিল। কারণ, পাকিস্তানের রক্ষণশীল পরিবেশে একজন অবিবাহিতা মহিলার রাজনীতি করা খুব কষ্টসাধ্য ছিল।
বেনজির কি তখন জানতেন যে তাঁর এই ‘অরাজনৈতিক’ স্বামী কীভাবে তাঁর দলকে পেছন থেকে ঘাপটি মেরে দখল করে নেবেন? তবে সেটা এক দিনে হয়নি, বহু বছর লেগেছে।
বিয়ের এক বছর পর বেনজির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের তৃতীয় সামরিক আইন প্রবর্তক এবং বেনজিরের পিতা জুলফিকার আলীকে ফাঁসির মঞ্চে চড়ানো জেনারেল জিয়াউল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে যদিও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ণ অনুমোদন ছিল।
এ নির্বাচনে জিয়াউল হক সৃষ্ট রাজনৈতিক সম্মিলিত দল বিশেষ করে মুসলিম লিগ এ নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচনে বেশি আসন পায় পিপিপি। আরেকটি ছোট দলের সহায়তায় বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর মন্ত্রিসভায় বেনজির কিন্তু আসিফ জারদারিকে নেননি। কিন্তু না নিলে কী হবে, প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসেবে তখন থেকেই আসিফ জারদারি টাকা রোজগারে মনোনিবেশ করেন।
সে টাকা দেওয়ার জন্য শুধু সিন্ধু প্রদেশই নয়, সারা পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা জারদারির দিকে মুখিয়ে থাকেন ব্যবসার জন্য। তিনি তাঁদের নিরাশ করেননি। লোকে তাঁকে তখন মিস্টার টেন পার্সেন্ট নামে ডাকতে থাকেন। অর্থাৎ যা ব্যবসা পাবে তার দশমাংশ জারদারিকে দিতে হবে। কিন্তু এ ব্যবসা তাঁর বেশি দিন টেকেনি, কারণ দুই বছরের মাথায় সামরিক বাহিনীর ইচ্ছায় বেনজিরকে চাকরিচ্যুত করেন তখনকার প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান দুর্নীতির অভিযোগে। কিন্তু বেনজির আবার ফেরত আসেন পরবর্তী নির্বাচনে দুই বছর পর যখন সামরিক শক্তি তার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে একই অভিযোগে সরিয়ে দেয়।
এবার বেনজির তাঁর মন্ত্রিসভায় আনেন তাঁর স্বামী আসিফ জারদারিকে, কারণ প্রধানমন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর বেনজির বুঝতে পারেন আসিফ জারদারি এর মধ্যে তার দলে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাঁর বেআইনিভাবে অর্জিত সম্পদের মাধ্যমে আর ছলচাতুরীতে।
তাঁর স্ত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পর আসিফ জারদারি স্থির করেন তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। একই সময় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলেও গোষ্ঠীগত রাজনীতির কারণে (তিনি সিন্ধের প্রভাবশালী জারদারি গোষ্ঠীর সন্তান) তিনি জেলে থেকেও নির্বাচনে জেতেন। আড়াই বছর জেলে থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণ, ব্যাংক ঋণখেলাপি, দুর্নীতি—এ ধরনের ২০০ মামলা করা হয়, কিন্তু কিছু প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পান।
হাঁসের মতো জেলের পানি ঝেড়ে আবার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরপরই বেনজির আবার প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি সরাসরি মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এবার মন্ত্রী হওয়ায় আসিফ জারদারির আরও ক্ষমতা বাড়ল আর দুর্নীতি এবং সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ আরও হলো।
মজার কথা, তাঁর এই ব্যাপক দুর্নীতির কথা সারা দেশে জানা থাকলেও বেনজির তাঁকে সরাতে সাহস করেননি, কারণ আসিফ জারদারি পিপিপির ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করেন। বলতে গেলে বেনজিরের দলের ওপর বেনজিরের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ছিল। পাকিস্তানে তখন তিনি প্রকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু দুই বছর পর ১৯৯৬ সালে বেনজির প্রতিষ্ঠানের কূটচালে আবার ক্ষমতা হারালে আসিফ জারদারি আবার গ্রেপ্তার হন ডজনখানেক মামলায়। কিন্তু আবারও তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ না থাকায় কোর্ট তাঁকে খালাস দেন। এত এত মামলা আর জেল খাটার পর (মোট ১১ বছর জেলে ছিলেন) আসিফ জারদারি রাজনীতি ছাড়েননি এবং তাঁর দলও তাঁর পিছু ছাড়েনি। ছেলেকে আলংকারিক চেয়ারম্যান বানিয়ে তিনি দলকে চালিয়ে নেন বছরের পর বছর।
তাঁর সর্বশেষ জাদুকরি ছিল পাকিস্তানের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবার ষড়যন্ত্র করে ইমরান খানের সরকারের পতন ঘটানো এবং পরে বেনজিরের এককালীন শত্রু নওয়াজ শরিফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠন। কিন্তু এবারের খেলাতে আসিফ জারদারি নতুন তুরুপ খেলেছেন।
তিনি বললেন যে নওয়াজ শরিফের দলকে তিনি সমর্থন করবেন, তবে নূতন সরকারের মন্ত্রী পরিষদে তাঁরা থাকবেন না। তাঁর শুধু চাই প্রেসিডেন্টের পদ। এবং তা-ই হলো, কারণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সেনাবাহিনী তাই চায়। এতে তারা দুটি শাসনতান্ত্রিক পদের ওপর তাদের দখল রাখতে পারবে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে আসিফ আলী জারদারির মতো ধূর্ত এবং ন্যায়নীতি বর্জিত ব্যক্তিত্ব খুব কমই জন্মেছেন। এ রকম ধূর্ত রাজনীতিবিদ এর আগে তাঁর শ্বশুর জুলফিকার আলীকে বলা হতো, কিন্তু আসিফ জারদারি তাঁকে বহু আগে ছাড়িয়েছেন তার স্থানকাল বুঝে শত্রুর সঙ্গে আপস, গোপন চুক্তি করে সব রকম সমস্যার সমাধান করা, আর কপটতার সঙ্গে শত্রু-মিত্রের সঙ্গে অনায়াস আচরণ। এ ধরনের লোক সব পরিস্থিতে নিজেকে সামলাতে পারে। (বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের এক ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম, কিন্তু তাঁর কথা এখন বাদ রাখি।)
কিন্তু আসিফ আলী জারদারির মতো লোক পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাজ করে আর চৌর্যবৃত্তি এবং কপটতা করে সম্পদ তৈরি করে চালিয়ে যায় কীভাবে? এর একটিই উত্তর। পাকিস্তানের রাজনীতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা চালান না। পাকিস্তানের রাজনীতি চলে আসছে পেছনে দাঁড়ানো সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানের হস্ত নির্দেশে। রাজনীতিতে থাকতে হলে এই প্রতিষ্ঠানের অনুগ্রহ অবশ্যই প্রয়োজন। যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য দেখান, তাঁরাই সরকার গঠন করেন।
আসিফ আলী জারদারি এই প্রতিষ্ঠানের মূল্য এবং ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি দেখেছেন কীভাবে এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তাঁর শ্বশুর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। তিনি দেখেছেন তাঁর স্ত্রী বেনজিরকে, প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার জন্য জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু আসিফ জারদারি এদের অবজ্ঞা না করে তাদের সঙ্গে গোপনে আপস করেছেন।
জানি না পাকিস্তান কবে এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু যত দিন পাকিস্তানে পারিবারিক গোত্রকেন্দ্রিক রাজনীতি চলবে, যত দিন আমলা এবং সেনাশাসিত শাসন চলবে, তত দিন আসিফ আলী জারদারির মতো পাকিস্তানের রাজনীতি পরিচালিত করবে।
পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলতে হলে প্রথমেই যেটা বলতে হয়, সে দেশে যা হয় তা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’। সে কর্তারা হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা বলতে গেলে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই রাজনীতির কলকাঠি চালিয়ে এসেছেন, হয় প্রত্যক্ষভাবে না হয় পরোক্ষভাবে।
পাকিস্তানের রাজনীতির এই ‘পুরনো খেলা’ নিয়ে তাই নতুন করে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু দেশটির রাজনীতির এক ‘জাদুকর’ আসিফ আলী জারদারির পুনরায় নাট্যমঞ্চে আবার প্রবেশ দেখে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে।
তিনি পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নাটকের এক ‘নাটগুরু’ হয়ে আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখনকার নিয়মে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি আলংকারিক পদ, তবুও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। জারদারির উত্থান–পতন আর পুনরাবির্ভাব শুধু পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘অদৃশ্য হাতের’ কথাই বলে না, পাকিস্তান কীভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি– সে কথাও বলে।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আততায়ীর হাতে মৃত্যু হয়। সেই সময় থেকে দেশটির সেনাবাহিনী পেছন থেকে পাকিস্তানের শাসনভার চালিয়ে আসছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও তার হাত আজও কঠিনভাবে দেশটির গলা টিপে আছে। গত সাত দশকের মধ্যে একটা বড় সময়ই পাকিস্তান সেনাশাসনের অধীনে ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা অর্থাৎ সেনাপ্রধান প্রত্যক্ষভাবে দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে মোটামুটি পাকিস্তানের অর্ধেক জীবন পার করেছে।
শুরু হয় আইয়ুব খান দিয়ে ১৯৫৮ সালে আর শেষ হয় ২০০৮ সালে পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালে প্রথম সামরিক আইন জারি করে নিজে শাসন হাতে নেন। দুই বছর পর নির্বাচন দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে পরোক্ষভাবে সামরিক শক্তি দিয়েই দেশ শাসন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
পারভেজ মোশাররফের পতন একভাবে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ শাসনভার থেকে আপাতভাবে সরালেও রাজনীতি থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির অদৃশ্য হাত সরে যায়নি। পারভেজ মোশাররফের শাসনকালেই আসিফ আলী জারদারির স্ত্রী বেনজির ভুট্টো (যিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) পাকিস্তানে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে বোমা হামলায় বেনজির নিহত হন। বেনজিরের মৃত্যুর পর জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেননি। কৌশলগত কারণে নিজে না হয়ে তাঁর ১৯ বছর বয়সী ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টোকে তিনি পিপিপির চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। তাঁর দল তা গ্রহণ করে।
কীভাবে আসিফ আলী জারদারি তাঁর দল পিপিপির ওপর বিপুল ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তার করেন, এটা ছিল তার একটা বিরাট প্রমাণ। অথচ বেনজির ভুট্টোকে বিয়ে করার আগে এ দলের ওপর তাঁর কোনো প্রভাব থাকা তো দূরের কথা, তিনি এ দলের কোনো উল্লেখযোগ্য সদস্যও ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের এক প্রখ্যাত জমিদারের পুত্র, অগাধ সম্পদের উত্তরাধিকারী। তিনি লন্ডনে লেখাপড়া করেছেন এবং বয়সে বেনজিরের চেয়ে দুই বছরের ছোট।
সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়, এ বিয়ে প্রেমের বিয়ে ছিল না। আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে এ বিয়ে হয়েছিল। বেনজির যে এ রকম এক ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন, তা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এক অভাবনীয় ছিল। বেনজির শুধু জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়েই নন, তিনি হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করেছেন। এরপর ফাঁসিকাষ্ঠে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মা নুসরাতের সঙ্গে পিপিপির হাল ধরেন।
এ রকম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আসিফ জারদারির মতো প্রায় অখ্যাত ব্যক্তিকে কেন বিয়ে করবেন, তা নিয়ে পাকিস্তানে বেশ গুঞ্জন হয়। কিন্তু বেনজির এ আলাপের বিয়েতে সহজেই রাজি হন, কারণ জারদারি দেখতে ভালোই ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আর বিয়ের সময় বেনজিরের সঙ্গে এ চুক্তি হয় যে তিনি রাজনীতি করবেন না। বেনজিরেরও তখন একটি বিয়ে হওয়া জরুরি ছিল। কারণ, পাকিস্তানের রক্ষণশীল পরিবেশে একজন অবিবাহিতা মহিলার রাজনীতি করা খুব কষ্টসাধ্য ছিল।
বেনজির কি তখন জানতেন যে তাঁর এই ‘অরাজনৈতিক’ স্বামী কীভাবে তাঁর দলকে পেছন থেকে ঘাপটি মেরে দখল করে নেবেন? তবে সেটা এক দিনে হয়নি, বহু বছর লেগেছে।
বিয়ের এক বছর পর বেনজির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের তৃতীয় সামরিক আইন প্রবর্তক এবং বেনজিরের পিতা জুলফিকার আলীকে ফাঁসির মঞ্চে চড়ানো জেনারেল জিয়াউল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে যদিও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ণ অনুমোদন ছিল।
এ নির্বাচনে জিয়াউল হক সৃষ্ট রাজনৈতিক সম্মিলিত দল বিশেষ করে মুসলিম লিগ এ নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচনে বেশি আসন পায় পিপিপি। আরেকটি ছোট দলের সহায়তায় বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর মন্ত্রিসভায় বেনজির কিন্তু আসিফ জারদারিকে নেননি। কিন্তু না নিলে কী হবে, প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসেবে তখন থেকেই আসিফ জারদারি টাকা রোজগারে মনোনিবেশ করেন।
সে টাকা দেওয়ার জন্য শুধু সিন্ধু প্রদেশই নয়, সারা পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা জারদারির দিকে মুখিয়ে থাকেন ব্যবসার জন্য। তিনি তাঁদের নিরাশ করেননি। লোকে তাঁকে তখন মিস্টার টেন পার্সেন্ট নামে ডাকতে থাকেন। অর্থাৎ যা ব্যবসা পাবে তার দশমাংশ জারদারিকে দিতে হবে। কিন্তু এ ব্যবসা তাঁর বেশি দিন টেকেনি, কারণ দুই বছরের মাথায় সামরিক বাহিনীর ইচ্ছায় বেনজিরকে চাকরিচ্যুত করেন তখনকার প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান দুর্নীতির অভিযোগে। কিন্তু বেনজির আবার ফেরত আসেন পরবর্তী নির্বাচনে দুই বছর পর যখন সামরিক শক্তি তার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে একই অভিযোগে সরিয়ে দেয়।
এবার বেনজির তাঁর মন্ত্রিসভায় আনেন তাঁর স্বামী আসিফ জারদারিকে, কারণ প্রধানমন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর বেনজির বুঝতে পারেন আসিফ জারদারি এর মধ্যে তার দলে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাঁর বেআইনিভাবে অর্জিত সম্পদের মাধ্যমে আর ছলচাতুরীতে।
তাঁর স্ত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পর আসিফ জারদারি স্থির করেন তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। একই সময় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলেও গোষ্ঠীগত রাজনীতির কারণে (তিনি সিন্ধের প্রভাবশালী জারদারি গোষ্ঠীর সন্তান) তিনি জেলে থেকেও নির্বাচনে জেতেন। আড়াই বছর জেলে থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণ, ব্যাংক ঋণখেলাপি, দুর্নীতি—এ ধরনের ২০০ মামলা করা হয়, কিন্তু কিছু প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পান।
হাঁসের মতো জেলের পানি ঝেড়ে আবার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরপরই বেনজির আবার প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি সরাসরি মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এবার মন্ত্রী হওয়ায় আসিফ জারদারির আরও ক্ষমতা বাড়ল আর দুর্নীতি এবং সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ আরও হলো।
মজার কথা, তাঁর এই ব্যাপক দুর্নীতির কথা সারা দেশে জানা থাকলেও বেনজির তাঁকে সরাতে সাহস করেননি, কারণ আসিফ জারদারি পিপিপির ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করেন। বলতে গেলে বেনজিরের দলের ওপর বেনজিরের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ছিল। পাকিস্তানে তখন তিনি প্রকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু দুই বছর পর ১৯৯৬ সালে বেনজির প্রতিষ্ঠানের কূটচালে আবার ক্ষমতা হারালে আসিফ জারদারি আবার গ্রেপ্তার হন ডজনখানেক মামলায়। কিন্তু আবারও তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ না থাকায় কোর্ট তাঁকে খালাস দেন। এত এত মামলা আর জেল খাটার পর (মোট ১১ বছর জেলে ছিলেন) আসিফ জারদারি রাজনীতি ছাড়েননি এবং তাঁর দলও তাঁর পিছু ছাড়েনি। ছেলেকে আলংকারিক চেয়ারম্যান বানিয়ে তিনি দলকে চালিয়ে নেন বছরের পর বছর।
তাঁর সর্বশেষ জাদুকরি ছিল পাকিস্তানের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবার ষড়যন্ত্র করে ইমরান খানের সরকারের পতন ঘটানো এবং পরে বেনজিরের এককালীন শত্রু নওয়াজ শরিফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠন। কিন্তু এবারের খেলাতে আসিফ জারদারি নতুন তুরুপ খেলেছেন।
তিনি বললেন যে নওয়াজ শরিফের দলকে তিনি সমর্থন করবেন, তবে নূতন সরকারের মন্ত্রী পরিষদে তাঁরা থাকবেন না। তাঁর শুধু চাই প্রেসিডেন্টের পদ। এবং তা-ই হলো, কারণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সেনাবাহিনী তাই চায়। এতে তারা দুটি শাসনতান্ত্রিক পদের ওপর তাদের দখল রাখতে পারবে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে আসিফ আলী জারদারির মতো ধূর্ত এবং ন্যায়নীতি বর্জিত ব্যক্তিত্ব খুব কমই জন্মেছেন। এ রকম ধূর্ত রাজনীতিবিদ এর আগে তাঁর শ্বশুর জুলফিকার আলীকে বলা হতো, কিন্তু আসিফ জারদারি তাঁকে বহু আগে ছাড়িয়েছেন তার স্থানকাল বুঝে শত্রুর সঙ্গে আপস, গোপন চুক্তি করে সব রকম সমস্যার সমাধান করা, আর কপটতার সঙ্গে শত্রু-মিত্রের সঙ্গে অনায়াস আচরণ। এ ধরনের লোক সব পরিস্থিতে নিজেকে সামলাতে পারে। (বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের এক ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম, কিন্তু তাঁর কথা এখন বাদ রাখি।)
কিন্তু আসিফ আলী জারদারির মতো লোক পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাজ করে আর চৌর্যবৃত্তি এবং কপটতা করে সম্পদ তৈরি করে চালিয়ে যায় কীভাবে? এর একটিই উত্তর। পাকিস্তানের রাজনীতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা চালান না। পাকিস্তানের রাজনীতি চলে আসছে পেছনে দাঁড়ানো সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানের হস্ত নির্দেশে। রাজনীতিতে থাকতে হলে এই প্রতিষ্ঠানের অনুগ্রহ অবশ্যই প্রয়োজন। যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য দেখান, তাঁরাই সরকার গঠন করেন।
আসিফ আলী জারদারি এই প্রতিষ্ঠানের মূল্য এবং ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি দেখেছেন কীভাবে এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তাঁর শ্বশুর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। তিনি দেখেছেন তাঁর স্ত্রী বেনজিরকে, প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার জন্য জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু আসিফ জারদারি এদের অবজ্ঞা না করে তাদের সঙ্গে গোপনে আপস করেছেন।
জানি না পাকিস্তান কবে এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু যত দিন পাকিস্তানে পারিবারিক গোত্রকেন্দ্রিক রাজনীতি চলবে, যত দিন আমলা এবং সেনাশাসিত শাসন চলবে, তত দিন আসিফ আলী জারদারির মতো পাকিস্তানের রাজনীতি পরিচালিত করবে।