পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা কারাবন্দি নেতা ইমরান খান বলেছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) কামার জাভেদ বাজওয়াকে বিশ্বাস করাটাই ছিল তার একমাত্র আফসোসের ব্ষিয়। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় বাড়ানোর জন্য তিনি ‘‘মিথ্যা ও অলীক’’ আখ্যান তৈরি করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ইমরান খান।
রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগার থেকে আলজাজিরার সাবেক সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব অভিযোগ করেছেন পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ওই সাক্ষাৎকার বুধবার মেহেদী হাসানের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম জেটিওতে প্রচার করা হয়েছে।
একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আদিয়ালা কারাগারে বন্দি পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দেশটির রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের— বিশেষ করে তার এক সময়ের বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়া সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন।
এই সাক্ষাৎকারের জন্য মেহেদী হাসান লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন ইমরান খানের কাছে। কারাগার থেকে তিনি কেবল সেগুলোরই জবাব দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে ইমরান খানকে পাল্টা প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। কারাবাসের জন্য তিনি কাকে দায়ী করছেন, মেহেদী হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরান খান বলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত যে আমার এই বন্দিদশা জেনারেল বাজওয়াই সাজিয়েছেন। এজন্য আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করি না।’’
‘‘তিনি সুক্ষ্মভাবে এই পরিকল্পনা সাজিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। বাজওয়া নিজেকে একজন প্রতারক হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য মিথ্যা ও ভুয়া আখ্যান তৈরি করেছেন। আর এর সবই নিজের মেয়াদ বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য করেছেন বাজওয়া।’’
২০১৯ সালে নির্ধারিত অবসরের মাত্র তিন মাস আগে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ নতুন করে তিন বছরের জন্য বৃদ্ধিতে অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ২০২২ সালে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম বোল নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান বলেছিলেন, তিনি বাজওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধিতে অনুমোদন দিয়ে ভুল করেছিলেন।
মেহেদী হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছেন, ‘‘তিনি (বাজওয়া) গণতন্ত্র ও পাকিস্তানের ওপর তার কর্মকাণ্ডের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।’’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরান দৃঢ়ভাবে সেই ঘটনায় কেবল সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়াকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘জেনারেল বাজওয়া এক তরফাভাবে আমার সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গল্পগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন, আমাকে আমেরিকাবিরোধী বা তাদের সাথে সুসম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলে তুলে ধরেছেন।’’
ইমরান বলেছেন, ‘‘ক্ষমতার জন্য অতৃপ্ত তৃষ্ণা তাকে (বাজওয়া) অপ্রত্যাশিত করে তুলেছে। জেনারেল বাজওয়ার ব্যক্তিগত লোভ তাকে একটি চীনা দোকানের ষাঁড়ে পরিণত করেছে।’’
পিটিআইয়ের এই প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, তিনি পাকিস্তানে আইনের শাসনের জন্য ধারাবাহিকভাবে লড়াই করেছেন। যদি ন্যায়বিচার সমানভাবে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে তার মতো কারও প্রয়োজন হবে না।
ইমরান খানের কোনো বন্ধু নেই, সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবসান ঘটেছে এবং পাকিস্তানি জেনারেল ও রাজনীতিবিদদের সাথে লড়াইয়ে হেরে গেছেন, মেহেদী হাসান এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বেশিরভাগ দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন— বিশেষ করে তার সরকার পতনের পর।
‘‘জেনারেল বাজওয়ার বিষের স্বল্পমেয়াদী প্রভাব থাকতে পারে, কিন্তু তা স্থায়ী হবে না,’’ বলেন ইমরান।
তিনি বলেন, ‘‘বেশিরভাগ দেশ পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনীতির অন্যতম ক্রীড়ানক শক্তি হিসেবে আমাদের সেনাবাহিনীকে দেখে। এই সত্যের প্রধান যখন নিষ্ঠুর কোনো ব্যক্তি হন এবং প্রতারণামূলক কাজে বাহিনীকে ব্যবহার করেন, তখন অনেক দেশের পক্ষে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়ে।’’
‘‘আমার চিকিৎসার কথা কেউ না বললেও আমার আপত্তি নেই। তবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও ২৫ কোটি মানুষের জন্য বিশ্বের আওয়াজ তোলা উচিত; যাদের ম্যান্ডেট দিনের আলোতে চুরি করা হয়েছে।’’
পাকিস্তানে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী প্রতীক বাতিল করায় ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআইয়ের প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচনে কারচুপির কথা উল্লেখ করে ‘‘চুরি করা ম্যান্ডেট’’ ফেরত পেতে সম্ভাব্য যেকোনো সংলাপের জন্য তিনি প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন।
দেশটির বর্তমান সরকারকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে ইমরান খান বলেন, এই সরকারের বৈধতা নেই। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভোটের আগে সহিংসতা, বিরোধীদের দমন-পীড়ন এবং ভোটের দিন কারচুপি স্পষ্ট ছিল। নির্বাচনের পর ফলাফল পরিবর্তন করতে তাদের প্রায় দুই দিন সময় লেগেছিল।