ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি)। সেই প্রতিবেদনে এই যুদ্ধের জন্য গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাস এবং ইসরায়েলের সরকার— উভয়কেই দায়ী করা হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ বাঁধার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয়েছিল এই প্রতিবেদন তৈরির কাজ। ইউএনএইচআরসির সাবেক প্রধান কমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের নেতৃত্বে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দলের অনুসন্ধান ও তদন্তের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে তদন্ত দলের সদস্যরা এই যুদ্ধ এবং তার পেছনে হামাস এবং ইসলায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন, উভয়পক্ষই যুদ্ধাপরাধের অপরাধে দায়ী। কারণ উভয়য়েরই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসরায়েল এবং গাজা বসবাসরত বেসামরিক লোকজন এবং হামাস-আইডিএফের সদস্যদের হাতে গত ৮ মাসে যত বেসামরিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে, সেসবের সবই হামাস এবং আইডিএফ সদস্যদের ইচ্ছাকৃত।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি ৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগও এনেছে জাতিসংঘের তদন্ত দল। এই অপরাধগুলো হলো নির্যাতন, জাতিগতভাবে গাজার ফিলিস্তিনিদের নির্মূলের চেষ্টা করা এবং ফিলিস্তিনি পুরুষ ও কিশোর-তরুণদের বেছে বেছে হত্যা করা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের পাশাপাশি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধেরও অভিযোগও এনেছে জাতিসংঘের তদন্ত দল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— সীমান্ত ও ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের মাধ্যমে গাজার বাসিন্দাদের না খেয়ে থাকতে বাধ্য করা, ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার-আটক এবং লাখ লাখ শিশুকে হত্যা করা, ফিলিস্তিনের জনগণকে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করা এবং গাজার বাসিন্দাদের সঙ্গে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গাজা অবরোধ এবং সেখানে বিদ্যুৎ, খাদ্য ও পানির যোগান সীমিত করে সেখানকার বাসিন্দাদের ‘সামষ্টিক শাস্তি’ দিচ্ছে ইসরায়েল।
হামাসের অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামাস যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলা, ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে অপরহণের মাধ্যমে এই ভয়াবহ যুদ্ধের সূত্রপাত। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা, হত্যা ও অপহরণের পাশাপাশি হামাস যোদ্ধারা ব্যাপকমাত্রায় যৌন সহিংসতা ঘটিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইউএনএইচআরসির প্রতিবেদনে। সেই সঙ্গে যাদেরকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদেরকেও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে এই সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে।
যুদ্ধ চলাকালে ফিলিস্তিনি নারীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে আইডিএফের সদস্যদের বিরুদ্ধেও।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য এখনও করেনি হামাস। তবে ইসরায়েলের ইতোমধ্যেই ইউএনএইচআরসির এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রতিবেদনটিকে ‘সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রভাবিত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মেইরাভ এইলন শাহার এক বার্তায় বলেছেন, জাতিসংঘ হামাস এবং ইসরায়েলের সরকারকে এক পাল্লায় বিবেচনা করেছেন যা ইসরায়েলের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর।
প্রসঙ্গত, এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় তথ্য সংগ্রহের জন্য ইসরায়েল ও গাজা সফর করেছেন তদন্ত দলের সদস্যরা। তদন্ত দলকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইউএনএইচআরসির এই প্রতিবেদন হামাস, ইসরায়েলের সরকার এবং আইডিএফকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যেতে পারবে না, তবে ভবিষ্যতে হামাস এবং ইসরায়েলের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করবে।