চলতি বছরের ডিসেম্বরে মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে নীতি সুদসহ সব ধরনের সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নীতি সুদহার বা রেপো রেট দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হবে। ফলে নীতি সুদহার এখন ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
রোববার ( ২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) প্রথম সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে।
রেপো হার বাড়ার মানে হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ও ব্যাংকের টাকা ধার করার সুদহার বাড়বে। একইসঙ্গে এর প্রভাবে ব্যাংকে আমানত ও ঋণের সুদহারও বাড়বে। এতে আমানত রাখার পরিমাণ বাড়বে এবং ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়।
নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে, বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলো।
রেপো সুদ বাড়ানোর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যান্য নীতি সুদহারও বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে। রিভার্স রেপো (জুলাই থেকে তা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ নাম) ও এসএলএফ-স্টান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (জুলাইয়ের আগে ছিল স্পেশাল রেপো) সুদহারও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া, নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।
যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়, তা হলো ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা– সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, এতদিন ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে পরবর্তী মাসের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হত। এখন তা ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।
চলতি বছরের অক্টোবরে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে নভেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সেই হিসাবে ঋণের সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সেই হিসেবে চলতি নভেম্বর মাসে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ সুদ নেওয়া যাবে। তবে নভেম্বরের ঠিক করা ঋণের এই সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে গত ২২ নভেম্বর পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. এজাজুল ইসলাম।
সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিকসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এর মাধ্যমে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। এদিকে, বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সহজ করে বলা যায়, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ হওয়া মানে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে একজন মানুষের যদি চাল, ডাল, চিনি, তেল, মাছ-মাংসসহ যাবতীয় খাদ্যপণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়; তাহলে এ বছরের অক্টোবরে একই খাবার কিনতে তার খরচ হয়েছে ১১২ টাকা ৫৬ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খাবার কেনায় প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১২ টাকা ৫৬ পয়সা।