মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের তরুণ আলাউদ্দিন। দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান আলাউদ্দিন ছিলেন লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল আলাউদ্দিনকে নিয়ে। ছেলে পড়াশোনা করবে, সংসারের অভাব দূর হবে এমনটাই আশা করতো আর্থিক টানাপোড়েনে দিন কাটানো পরিবারটি। তবে তাদের সব আশার প্রদীপ মুহূর্তেই নিভে যায় একটি ধাক্কায়।
২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন আলাউদ্দিন। পরীক্ষা শুরুর কয়েকদিন আগেই কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ হারান তিনি। ১০ বছর কেটে গেলেও প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি আলাউদ্দিনের পরিবার। ঘুরে দাঁড়ানো তাদের আর হয়নি। আলাউদ্দিনের পরিবারের মতো শতশত পরিবারের স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত অবধি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা মেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর। সড়কগুলো যেন হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। সুস্থ যে মানুষটি সংসারের জন্য দুপয়সা আয়ের উদ্দেশে পথে বের হলেন, তিনি হয়তো ঘরে ফিরলেন নিথর দেহে। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যরা হয়ে পড়েন নিঃস্ব। জীবন বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাদের সামনে।
দেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষের প্রাণ যায় সড়কে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে একেক প্রাণের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবারের স্বপ্নও। আবার পঙ্গু হয়ে সমাজ-সংসারের বোঝা হিসেবেও বেঁচে আছেন অনেকেই। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে না, এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতেও। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের আর্থসামাজিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) পুলিশের তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে জানায়, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছর। এ ৫৪ শতাংশের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ২০১৭ সালে প্রকাশ করা এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তির প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার ক্ষতি হয়। তবে এর সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবারের অর্থনৈতিক চাপ, কর্মক্ষেত্রের ক্ষতিসহ অন্যান্য বিষয় আমলে নেওয়া হয়নি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৬ জন।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ৩ হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৭ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৭২ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন (নিশচা)।
বুয়েটের গবেষণা মতে, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। এছাড়া সড়ক-মহাসড়কে চলা প্রায় ১০ লাখ অনিবন্ধিত বাহন। টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, গণপরিবহণকে শক্তিশালী না করায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে।
সড়ক উন্নত, যানবাহন সেকেলে
সড়কের উন্নতি হচ্ছে রোজ। আধুনিক হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবু কেন লাগাম টানা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনায়? যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের শিক্ষক ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের মতে, গত এক যুগে অবকাঠামো উন্নয়নে যেভাবে বিনিয়োগ হয়েছে, তা মূলত সড়কের গতি বাড়ানোর জন্য। কিন্তু দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কেবল অবকাঠামোভিত্তিক বিষয় নয়। এখানে অবকাঠামো যেমন স্মার্ট হচ্ছে, তেমনই যারা ব্যবহারকারী, চালক বা পথচারী আছেন, তাদেরও সচেতন হতে হবে। সড়ক স্মার্ট হলেও যানবাহন রয়ে গেছে সেকেলে। এমনটাই মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘আনফিট যানবাহন, চালকের অভিজ্ঞতার ঘাটতি, রুট পারমিটবিহীন যান চলাচল থেমে নেই। সেই সঙ্গে চালকদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তো আছেই। সবমিলিয়ে বলা যায়, সড়কের উন্নতি হলেও শৃঙ্খলার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
একই বক্তব্য নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনের। তিনি বলেন, ‘শুধু অবকাঠামো করলেই হবে না, ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটাতে হবে। যতক্ষণ আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব না হবে, ততক্ষণ কাজের কাজ কিছুই হবে না।
নিরাপদ সড়কে অনিরাপদ যান চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সড়কটা নিরাপদ করে বানালাম; কিন্তু চলছে সেই পুরোনো গাড়ি। গাড়ির ফিটনেসের তো একটা বয়স থাকে। নতুন সড়ক আইনে ২৫ বছরের পুরোনো গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবহন মালিকদের কারণে তা হচ্ছে না। ওই গাড়ি যখন সড়কে যাচ্ছে, তখন নিরাপত্তা থাকল কোথায়?’
ক্ষতিপূরণ কতটা?
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত বা আহত হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। এই ক্ষতিপূরণের তহবিল গঠন করতে মোটরযান মালিকদের কাছ থেকে প্রতিবছর নির্ধারিত পরিমাণে টাকাও নেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে ক্ষতিপূরণ তহবিল চালু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে ২০০ কোটি টাকার মতো জমা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা।
এই ক্ষতিপূরণ তহবিল সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের নেই ধারণা। আবার ক্ষতিপূরণের আবেদনেও রয়েছে নানা জটিলতা। তাই প্রয়োজন হলেও ক্ষতিপূরণের আবেদনে আগ্রহী হন না অনেকেই।
২০১৮ সালের সড়ক পরিবহণ আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ এবং আহত, অঙ্গহানি বা পঙ্গু হলে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। তবে এ ক্ষতিপূরণের টাকা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে সরকারের তরফ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং আহতকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর হতাহতের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। এ তালিকা অনুযায়ী যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কিছুটা স্বস্তির সুবাতাস পেতে পারে। এমনটাই মনে করেন মো. মোজাম্মেল।
ক্ষতিপূরণ তহবিলের ব্যবস্থাপনা আরও সহজ করা উচিত বলে মনে করেন মো. মোজাম্মেল। তিনি মনে করেন, জনগণের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ নেওয়া হয়, তা যেন সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়। এ ব্যাপারের সরকারের সতর্ক হওয়া দরকার।
ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদনের সময় বাড়ানো দরকার বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের আবেদনের সময় রাখা হয়েছে মাত্র ১ মাস। একজন ব্যক্তি পঙ্গু হলেও তার চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৪ মাস সময় লাগে। কখনো কখনো তা ৬ মাসও লেগে যায়। এ সময়ে সে চিকিৎসা নেবে না ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের দপ্তরে দপ্তরে দৌড়াবে? তাই আমি মনে করি, ক্ষতিপূরণের আবেদন জমা দেওয়ার সময় এক বছর বাড়ানো প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো নজরে নেওয়া গেলে জনগণ ক্ষতিপূরণ তহবিলের সুফল পাবে।’
দিনকে দিন রেকর্ড ভাঙছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে নিহত আর আহতের সংখ্যা। এটি কমানোর কি কোনো উপায় নেই? অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে চাইলে সমানতালে ৫টি বিষয়ে কাজ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ ব্যবহারকারী ও চালক, নিরাপদ গতি। আরও আছে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, দুর্ঘটনার পর ট্রমা ম্যানেজমেন্ট।’ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে কিংবা আহত হলে থেমে যায় জীবনের চাকা। ক্ষতিপূরণ মিললেও তা উপযুক্ত নয়। আর যাই হোক, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির প্রয়াণ কিংবা সারা জীবন কাজ করার ক্ষমতা হারানোর কোনোটিই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। সড়কের উন্নতির পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা আরও গোছাল হবে, চালক আর পথচারী উভয়ই সচেতন হবে এমনটাই কাম্য সবার। তবেই হয়তো থামবে সড়কে মৃত্যু-মিছিলের যাত্রা।