দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটগ্রহণের মধ্যদিয়ে এ আয়োজন সম্পন্ন হবে। উৎসবমুখর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি নির্বাচন করার লক্ষ্যে সরকার তথা নির্বাচন কমিশন পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভোটের মাঠে থাকা এমপি প্রার্থী এবং তাদের পক্ষের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণার সাথে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে সরকারের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনসহ বেশকিছু রাজনীতিক দল নির্বাচনে না থাকায় ভোটের এ উৎসবে কিছুটা ভাটা পড়েছে। নির্বাচন হবে এটি সবাই জানলেও ভোট দেয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে নেই কোনো উৎসাহ ও আগ্রহ। সাধারণত নির্বাচনের সময় ভোটারদের কদর বাড়ে। প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের প্রচার-প্রচারণায় প্রতিটি এলাকায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। কিন্তু এবার তার কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তবে সবকিছু মিলিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশের ন্যায় চাঁদপুরেও বইতে শুরু করেছে ভোটের উত্তাপ। এবারের সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুরের ৫টি আসনে ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্চ্ছেন ৩০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে নৌকার প্রতিপক্ষ হিসেবে অন্য দলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন নৌবাবঞ্চিত একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা। ভোটের মাঠে নৌকা- ঈগল প্রতীকের পাশাপাশি লাঙ্গল, ট্রাক ও নোঙ্গর প্রতীকের প্রার্থীরাও পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন।
চাঁদপুর জেলা নির্বাচন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ হালনাগাদ ভোটার তালিকায় জেলার ৫ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২১ লাখ ৫৬ হাজার ৬০৯ জন। এদের প্রায় অর্ধেকই মহিলা ভোটার। এদের সংখ্যা ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৩২ জন । পুরুষ ভোটার ১১ লাখ ১২ হাজার ৫৭৭ জন।চাঁদপুর- ১ (কচুয়া): আসনে ভোটার সংখ্যা ৩২৫৭৫৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৬৯৩৩১ জন, নারী ভোটার ১৫৬৪২৮ জন।
চাঁদপুর-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এ আসন থেকে তিনি তিনবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। এ আসনে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ এর মনোনীত মো. সেলিম প্রধান (চেয়ার), জাসদ মনোনীত প্রার্থী সাইফুল ইসলাম (মশাল) প্রতীক নিয়ে।
সূত্র জানায়, এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী ৩ জন। এদের কেউই এর আগে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হননি। সুতরাং, ভোটাররা যাকেই নির্বাচিত করুক না কেন, এখানে একজন নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।
চাঁদপুর- ২ (মতলব দক্ষিন ও মতলব উত্তর) আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪৬৭২২৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২৩৮৬৩৪ জন এবং নারী ভোটার হচ্ছে ২২৮৫৯৪ জন। অতীতে এই আসন থেকে যে দলের প্রতিনিধি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলই সরকার গঠন করেছে। রাজধানীর সন্নিকটে হওয়ায় এই আসনের গুরুত্ব বেশি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েট নেতা ও সরকারের আমলাদের জন্মস্থান এখানে। প্রায় সব সরকারের আমলে এই আসন মন্ত্রী পেয়েছে। তাই উন্নয়নও হয়েছে ব্যাপক। আগামী নির্বাচনেও তেমনটা চান তাঁরা। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম। তিনি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ আসনে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন জাতীয় পার্টির এমরান হোসেন মিয়া (লাঙ্গল), সুপ্রিম পার্টির মোহাম্মদ মনির হোসেন বেপারী (একতারা), স্বতন্ত্র এম. ইসফাক আহসান (ঈগল), জাসদের মোহাম্মদ হাছান আলী শিকদার (মশাল) প্রতীকে।
চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর সদর-হাইমচর): এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫,০৮,৯৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২,৬৩,৮৯৩ জন । নারী ভোটার ২,৪৫,০৩৯ জন। চাঁদপুর-৩ আসনটি বিভিন্ন কারণে বেশ আলোচিত, আসনটি ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদের কন্যা বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের আসন হিসেবে দেশব্যাপী অধিক পরিচিত। একটি পৌরসভা, ২ টি উপজেলা ও ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত আসনটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ২৬২ তম আসন। চাঁদপুর সদর উপজেলা ও হাইমচর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটার সংখ্যা ৪৩০২৫৭ জন। চাঁদপুর-৩ আসন থেকে গত ৩ বারের নির্বাচিত এমপি ডা. দীপু মনি। তবে এই আসনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য আছে বলা যাবে না। কারণ এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরাই জয়লাভ করেছিল। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আলম খান এবং ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জি এম ফজলুল হক জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে এই আসনে বিএনপির আধিপত্য ভঙ্গ করেন ডা. দীপু মনি। ওই নির্বাচনে ডা. দীপু মনি পান ১৩৪৮৩৬টি ভোট। আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জি এম ফজলুল হক ১১৬০৬৮টি ভোট পেয়ে প্রায় ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এবারও চতুর্থবারের মতো নৌকার মনোনয়ন পান ডাঃ দীপু মনি।
চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের ডা. দীপু মনি (নৌকা), মার্কার বিপরীতে ভোটে লড়বেন স্বতন্ত্র ড. মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া (ঈগল), মো. রেদওয়ান খান (ট্রাক), জাতীয় পার্টির মো. মহসীন খান (লাঙ্গল), বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্টের আবু জাফর মো. মাঈনুদ্দিন (মোমবাতি), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মো: মিজানুর রহমান পেয়েছেন (ফুলের মালা), জাকের পার্টির মোঃ. কাওছার মোল্লা (গোলাপ ফুল) প্রতীক নিয়ে।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ ) ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে এ আসন গঠিত। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩,৬৯,১২৯ জন । পুরুষ ভোটার হচ্ছে ১,৯২,৭৬৮ জন। নারী ভোটার হচ্ছে ১,৭৬,৩৬১ জন। চাঁদপুর জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ)। আসনটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বলে জেলায় পরিচিত। ভোটার সংখ্যাও বেশি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্রমশ জমে উঠছে নির্বাচনী হাওয়া। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ আসনটি বেশিরভাগ সময় বিএনপির দখলে থাকলেও ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মধ্যদিয়ে আসনটি হাতছাড়া হয়ে আ’লীগের দখলে চলে যায়। মূলত এ আসনটিতে বিএনপির বড় অঙ্কের ভোট ব্যাংক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ আসনটিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিএনপির দুর্গে হানা দিয়ে এখন আসনটিতে আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ড. শামছুল হক ভূইয়া বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমান বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য লায়ন হারুন-অর রশিদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবারও তিনি নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সঙ্গে হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন ড. মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া(ঈগল), জালাল আহমেদ (ট্রাক), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আব্দুল গনি (আম), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের বাকী বিল্লাহ মিশকাত চৌধুরী (ফুলের মালা), তৃণমূল বিএনপি’র মোঃ আব্দুল কাদের (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ড. মুহাম্মদ শাহজাহান (নোঙর), জাতীয় পার্টির সাজ্জাদ রশিদ (লাঙ্গল) প্রতীক নিয়ে।
চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি): এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৪,৮৫,৫৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার হচ্ছে ২,৪৭,৯৫১ জন, নারী ভোটার ২,৩৭,৬১০ জন। এ আসনে মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম নৌকার হেভিওয়েট পার্থী হিসেবে প্রতিদিন করছেন। তিনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
চাঁদপুর-৫ (শাহারাস্তি ও হাজীগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের (নৌকা) প্রতীকের সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী মো. মাঈনুদ্দিন (ঈগল), মো. শফিকুল আলম (ট্রাক), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী (চেয়ার), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের এর বাকী বিল্লাহ মিশকাত চৌধুরী (ফুলের মালা), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের আক্তার হোসেন (ছড়ি) প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুরের পাঁচটি আসনে ৮ উপজেলায় ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৭ শতাধিক। চাঁদপুর-১ (কচুয়া) -১০৯ টি, চাঁদপুর-২ (মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে) ১৫৫ টি, চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে)-১৬৫ টি, চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জে)-১১৮ ও চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তিতে) ১৫৩টি ভোট কেন্দ্রে রয়েছে। এই জেলায় ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নবম, দশম ও একাদশ সংসদীয় নির্বাচনে সব আসনেই নির্বাচিত হয়েছেন বর্তমান ক্ষমতসীল আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা। জেলার ৭টি পৌরসভা ও ৮৯টি ইউনিয়ন রয়েছে।