তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অন্য জ্বালানির তুলনায় তিন গুণের বেশি। তবু সারা বছরই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সরকার। বসে থাকছে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি অংশ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে এখন ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে জ্বালানি খরচ গড়ে ১৭ টাকা। গ্যাসে খরচ দাঁড়ায় চার টাকার আশপাশে। কয়লায় ব্যয় ছয় টাকার মতো।
ব্যয় বেশি হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে তেল ব্যবহার করে।
একই অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় ২৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি ইউনিট ১১ টাকা ৫২ পয়সায়, যার একটি কারণ তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমালে বছরে সাশ্রয় হতে পারে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১৯ ফেব্রুয়ারি বলেন, চাহিদামতো গ্যাস পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। আমদানি করে গ্যাস দিলেও খরচ অনেক কমবে। তিনি বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও খরচ অনেক কমেছে। কিন্তু গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ বকেয়া। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেনাও শোধ করা যাচ্ছে না। ফলে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। প্রতিমন্ত্রীর দাবি, বাধ্য হয়েই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। ভর্তুকি বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ এবং আমদানির জন্য মার্কিন ডলার পাওয়া গেলে গ্যাস ও কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেল আমদানি করতেও ডলার লাগে। সেই ডলার দিয়ে গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা যায়। তাঁদের মতে, বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সুবিধা দিতে সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়। এ কারণে সরকারি ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও কম চালানো হয়। এসব কেন্দ্রে সক্ষমতার মাত্র ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বেসরকারি ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যবহার করা হয় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। সার্বিকভাবে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ কেনা হয় সরকারি (পিডিবির মালিকানাধীন) কেন্দ্র থেকে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম ২৭ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘২০২২ সালে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানিতে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলাম, বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) যে দামে ফার্নেস তেল আমদানি করে, তার চেয়ে প্রতি লিটারে ১৮ টাকা বেশি দর দেখিয়ে বিল নেয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এতে বাড়তি ব্যয় আট হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের কারণেই ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালানো হয়।’উচ্চ ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে বাড়তি দাম সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। সরকার আবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে। শিগগিরই আসতে পারে সেই ঘোষণা। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছেন, এ দফায় দাম বাড়তে পারে ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা।
লোডশেডিংও আছে
বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতির মধ্যে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়। বিদ্যুৎ খাতে দ্রুত বিনিয়োগ টানতে তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এই আইনের অধীনে প্রতিযোগিতা ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আইনটির মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছে। এখনো বলবৎ আছে।
এদিকে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে; কিন্তু জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। ২০২২ ও ২০২৩ সালে লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এবার শীত না যেতেই গ্রামে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। মার্চ থেকে সারা দেশেই লোডশেডিং বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ক্যাবের শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি ব্যয় হয়। সেটি কমালে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।