চাঁদপুরের তিন কৃতী সন্তানকে সংবর্ধনা প্রদান করলো চাঁদপুর প্রেসক্লাব। গত ১ মার্চ বিকেলে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধিতরা হচ্ছেন- আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুজীববিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার এবং ৬বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার ও সাংবাদিক কবির বকুল।
অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াত, গীতা পাঠ, জাতীয় সংগীত ও প্রেসক্লাবের থিম সং পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সূচনা হয় অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা ছাড়াও সংবর্ধনা পর্ব, বিশেষ সম্মাননা প্রদান আয়োজন ছিলো দারুণ উপভোগ্য।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের ২০২৪ সালের কার্যকরী কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এমপি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে অতিথিবৃন্দ এবং সংবর্ধিত অতিথিদের উত্তরীয় পড়িয়ে, ক্রেস্ট প্রদান ও বই উপহার তুলেন দেন প্রধান অতিথিসহ অতিথিরা।
সংবর্ধিত অতিথির বক্তব্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনুজীব বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা বলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ চাঁদপুর প্রেসক্লাবকে। যখন ঘরে সম্মান পাই তার চেয়ে খুশির আর কিছু নেই। চাঁদপুর আমার বাড়ি ও আমার দেশ। আমি ঘরের মানুষ। আমি ১১ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এখন আমি দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই, তাই দেশে ফিরে এসেছি। আমি মূলত কাজ করি, একটি শিশু যে রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছে। সে রোগ কি কি কারণে হয়েছে, খুঁজে বের করি। দেশের মানুষকে সুষ্ঠু থাকতে হবে ভালো থাকতে হবে।
সংবর্ধিত অতিথির বক্তব্যে ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার ও সাংবাদিক কবির বকুল বলেন, আমার জন্য সবচেয়ে স্বাদ পছন্দের জায়গা হচ্ছে লেখালেখি। আমার শুরুটা হচ্ছে মফস্বল শহর চাঁদপুর থেকে। এই শহরে আমি পুরোপুরি তৈরি হয়ে ঢাকাতে গিয়েছি। আজ চাঁদপুর প্রেসক্লাব আমাকে যে সংবর্ধনা দিয়েছে সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির হাত থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি যার হাত থেকে যে সংবর্ধনা গ্রহণ করি তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি।
সংবর্ধিত অতিথি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, এটি আমার জন্যে বিরল সম্মান। সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি যখন শিক্ষামন্ত্রী তখন আমি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হই। আমি চাঁদপুরের সন্তান হিসেবে চাঁদপুরের জন্য যা যা করণীয় তাই করবো।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মনজুরুল আহসান বুলবুল, জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক বশির আহমেদ, পুলিশ সুপারের পক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সুদীপ্ত রায়, চাঁদপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ ওচমান গনি পাটওয়ারী, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. জিল্লুর রহমান জুয়েল ও দৈনিক যুগান্তরের যুগ্ম-সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রোটা. মাহবুবুর রহমান সুমন ও সাবেক সভাপতি এএইচএম আহসান উল্লাহ‘র যৌথ পরিচালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাব সভাপতি শাহাদাত হোসেন শান্ত। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কাজী শাহাদাত ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা। এসময় স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী, চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মো. মানোয়ার হোসেন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত জামিল সৈকতসহ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সুধীজন, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ চাঁদপুর প্রেসক্লাব, টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম ও ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সকল পর্যায়ের সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সাংবাদিক, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা পেশায় জড়িতরা অনেকে উপস্থিত ছিলেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন মাও. আব্দুর রহমান গাজী, গীতাপাঠ করেন সাবেক সেক্রেটারী লক্ষণ চন্দ্র সূত্রধর। এরপর সম্প্রতি মৃত্যুবরণকারী চাঁদপুর প্রেসক্লাবের দু‘জন সদস্য ড. মো. সামছুল হক ভূইয়া, মাহমুদ হোসেনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের শিল্পীবৃন্দ জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। সেই থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চাঁদপুর জেলার সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন চাঁদপুর প্রেসক্লাব পার করেছে ৫৪ বছর। অনেক আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে এ প্রেসক্লাব পরিণত হয়েছে একটি পরিবারে।
সংবর্ধিত ৩ জনের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত :
ড. সেঁজুতি সাহা : ড. সেঁজুতি সাহা একজন পরিচালক এবং সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে চাইল্ড হেলস্থ্য রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ), বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। তিনি প্রতিরোধযোগ্য শিশু সংক্রামক রোগ সম্পর্কিত মৌলিক গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় হতে অণু জীনবিদ্যা বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করে তিনি স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং হসপিটাল ফর সিক চিলড্রেন থেকে পোস্ট ডক্টরাল প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ড. সেঁজুতি সাহা ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সম্মুখসারির কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন এবং বশঃর এবহড়সরপং ঈবহঃবৎ প্রতিষ্ঠা করেন। ড. সাহা জীনগত রোগবিস্তারবিদ্যা; টাইফয়েড, প্যারা টাইফয়েড এবং ক্লেবসিয়েলা সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ধরন নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি শিশুদের মেনিনজাইটিস সংক্রমণে চিকনগুনিয়াকে কারণ হিসেবে চিহ্নিতকরণ, বাংলাদেশে প্রথম ঝঅজঝ-ঈড়ঠ-২ জিনোম ধারাক্রম তৈরি করা এবং বাংলাদেশে রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস সংক্রমণের ভার অনুধাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল কমিটির একজন সদস্য।
তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন যার মধ্যে বাংলাদেশে নারীদের জন্যে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেসা অ্যাওয়ার্ডও অধিভুক্ত আছে। তাঁর কাজ কেবলমাত্র বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায় না বরং সবার কাছে পৌঁছানো এবং সবার উপকারে লাগার বিষয়টিও নিশ্চিত করে।
কবির বকুল : কবির বকুল ১৯৬৬ সালের ২১ নভেম্বর চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কবির বকুল দৈনিক ভোরের কাগজে যোগ দেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রথম আলোতে কর্মরত ছিলেন। মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব ইভেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২০১১ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত।
২০১৫ সালের ১ জুন থেকে তিনি তার পুরানো কর্মস্থল দৈনিক প্রথম আলোতে আবার যোগ দেন। তিনি ১৯৯৪ সালে ‘অগ্নি সন্তান’ চলচ্চিত্রে প্রথম গান লেখেন। এ গানের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির পুরস্কার শ্রেষ্ঠ গীতিকারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। সেরা গীতিকার হিসেবে তিনি ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
কবির বকুল ১৯৮৬ সাল থেকে কবিতা, গান লেখালেখির সাথে জড়িত। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রথম ১৩টি গান লিখে শিল্পী তপন চৌধুরীকে দেন। সেখান থেকে দুটি গান দুটি অ্যালবামে আসে। প্রথম গান ছিল ‘কাল সারা রাত তোমারই কাঁকন যেন মনে মনে রিনিঝিনি বেজেছে’ যার গায়ক ছিলেন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। দ্বিতীয় গানটি ছিলো ‘পথে যেতে যেতে খুঁজেছি তোমায়’ যার গায়ক ছিলেন শিল্পী নাসিম আলী খান। এখন পর্যন্ত তিনি ৮ শতাধিক ছায়াছবির গান লিখেছেন এবং সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি গান লিখেছেন। বর্তমানে কবির বকুল প্রথম আলোর বিনোদন হেড পদে কর্মরত আছেন।
মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার : প্রকৌ: মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫সালে জন্মগ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (পুরকৌশল) এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে তিনি সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে ১৭ বছর, নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে ৮ বছরের অধিক মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন। শুধু তাই নয়, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসাবে ৩ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন।
তিনি প্রকৌশলী হলেও আছে লেখালেখির হাত। তাঁর লেখা জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, মানবকণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।