মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরোতেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। কিন্তু অদম্য মানসিকতা যাঁর, তিনি এখানেই থেমে যাবেন, তা কি হয়! সংসার-সন্তান সামলে চুকিয়েছেন পড়াশোনার পাটও। চাকরি নয়, ব্যবসা করবেন, স্বাবলম্বী হবেন। তাই স্বামীর দেয়া হাতখরচের টাকা জমিয়ে স্বল্পপুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বেড়েছে কলেবর। তাঁর সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার নানা চড়াই-উতরাইয়ের গল্প লিখেছেন এই প্রতিবেদক। ইয়াসমিন সুলতানা, পরিবারের ৬ ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম সন্তান। জন্ম-বেড়ে উঠা চাঁদপুর জেলাতে। ২০০৯ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী জিলানী চিশতি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন তিনি। শৈশব ও পড়াশোনা চাঁদপুরে হলেও স্বামীর চাকরিসূত্রে ঢাকার সাভারে তার বসবাস। বর্তমানে স্বামী-সংসার সামলে দেশীয় পণ্যের একজন ই-কমার্স উদ্যোক্তা ইয়াসমিন। ফেসবুক পেজ ‘সঞ্চয়িতা’ ঘিরেই এখন তার স্বপ্ন। সম্প্রতি ইয়াসমিন সুলতানা তার উদ্যোগের গল্প বলেছেন এই লেখককে।
শুধু মনের জোর আর সদ্বিচ্ছার কারণে একজন শূন্য থেকে শুরু করে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে কীভাবে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করা যায় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অদম্য সংগ্রামী নারী ইয়াসমিন। আজ তিনি সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। এই পথটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পরিক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সেই গল্প জানতে যেতে হবে আরো অনেক পেছেনে। ইয়াসমিনের শৈশব ও কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলো কাটে চাঁদপুরেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখা করেন সেখান থেকে। স্কুল- কলেজ জীবন, সব কিছুই ছিল রঙিন। কলেজ ক্যাম্পাস, পড়ালেখা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়া, মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়ানো, সব কিছুই চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। হঠাৎ করেই বদলে গেলো তার জীবনের দৃশ্যপট। তখনও সবেমাত্র পড়ছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষে। পারিবারিকভাবে হঠাৎ করে তাকে দেয়া হয় বিয়ে। পরে যেতে হয় শ্বশুর বাড়িতে। শুরু হয় নতুন জীবন। স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে পাশ করেন এইচএসসি। এর পরেই জন্ম দেন একটি কন্যা সন্তান।
বিয়ের পর সব কিছু তার কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। নিজের পড়ালেখার স্বপ্ন, স্বামী-সংসার, সন্তানের সেবাযত্ন কিভাবে কি করবেন তা নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়ে যান ইয়াসমিন। এক বছর বিরতি দিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে আরো দুঃচিন্তায় পরে যান তিনি। পড়ালেখা করে চাকরি পাওয়া যেন সোনার হরিণ। পেলেও স্বামী-সংসার ও মেয়েকে সামাল দেয়ার কেউ থাকবে না। এমনটা ভেবেই অন্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা মাথায় আসে তার। স্বামীর দেয়া হাত খরচের সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে শুরু করেন দেশীয় পণ্যের অনলাইন ব্যবসা। শুরুতেই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার বিখ্যাত মোমবাটিক পোশাক নিয়ে ২০১৯ সালে কাজ শুরু করেন এই নারী উদ্যোক্তা। কিন্তু এর মধ্যে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও চলে আসে মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। তাই কোভিড চলে আসায় সব কাজ থমকে যায় ইয়াসমিনের। ২০২০ সালে ঘরবন্দি অবস্থায় ৩ মাসের সন্তান নিয়েও সাহস করে ‘সঞ্চয়িতা’ নামে ফেইসবুক পেজ খুলে চালিয়ে যান তার এই ই-কমার্স ব্যবসা।
তিনি জানান, বাটিক নিয়ে একটা সময় আমার ধারণা ছিলো কমদামী সস্তা পোশাক। কিন্তু না একটা ভালো মানের বাটিক ব্যবহারের পর আমার সেই ভুল ভাঙ্গে। তখনি মাথায় আসে অন্যদের যেই ভুল ধারণা সেটাকে বদলাতে হবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যকে নতুন করে পরিচিত করাতে হবে সবার কাছে। সেই চিন্তা থেকেই ধীরেধীরে এগিয়ে চলা। বাটিক শুনলেই কমদামি মনে করে নাক সিটকান এমন অনেকের পড়নেও আরামদায়ক বাটিক। আমার প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়িতার ট্যাগ লাইন হচ্ছে “কোয়ালিটি ফার্স্ট” আর সেটার সাথে কখনোই আপোষ করিনি। তাই নিত্য নতুন ক্রেতার সাথে সাথে অসংখ্য রিপিট ক্রেতাও পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। তার জন্য আলহামদুলিল্লাহ। দীর্ঘ ৪ বছরের ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ক্রেতাদের সন্তুষ্টি। তবে শুরু থেকেই আমার স্বামী ছায়ার মতো পাশে ছিল। যেকোনো সমস্যায় সে-ই সাহস জোগাত। সময়-সুযোগ করে নানা কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
জানা যায়, বাহারি ডিজাইনের মোমবাটিকের কটন ও সিল্ক থ্রিপিস, বাটিকের সিল্ক ও কটন শাড়ি আর বেডশিট তার সঞ্চয়িতা পেজ থেকে লাইভে এসে প্রদর্শনী শুরু করেন। ওই লাইভ সম্প্রচারে দেশ- বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের তিনি দেশীয় পণ্যের ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। ক্রেতারা তার লাইভ দেখে নিজের পছন্দমতো পোশাকটি অর্ডার করতে শুরু করেন। প্রতি লাইভে অর্ডার করা পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্রেতাদের কাছে ডেলিভারিতে পৌঁছানোর যাবতীয় কাজও ইয়াসমিন স্বামীর সহযোগিতায় করে থাকেন। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত অনলাইন ও অফলাইনের প্রশিক্ষণ নেয়া এই উদ্যোক্তা ২০২৩ সালে ইউএনডিপি ও আনন্দমেলার অধীনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আইসিটি গ্র্যান্ড ৫০ হাজার টাকার পুরষ্কার গ্রহণ করেন। যা একজন নারী উদ্যোক্তার উন্নয়নের জন্য সরকারের এই ভূমিকা সত্যিই অনস্বীকার্য।
তিনি জানান, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণে যুক্ত করে নিজেকে দক্ষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি শুরু থেকেই। বর্তমানে সঞ্চয়িতার পুরো কার্যক্রম অনলাইনে চললেও স্বপ্ন দেখি একদিন এই উদ্যোগ অফলাইনেও প্রকাশ পাবে। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছে আমার স্বামী। সে আমাকে সাপোর্ট না করলে আজ আমার যাত্রা এতোদূর এগিয়ে আসতো না। তিনি আরো বলেন, মাত্র ৩৫০০ টাকায় শুরু করা বিজনেস টাকে ৪ বছরে যেটুকু এনেছি তার জন্য এখনো কোন ঋণ করতে হয়নি। আমার এই বিজনেসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পুঁজি রয়েছে এখন। নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকে করেছি। যেহেতু বিজনেস টা অনলাইন ভিত্তিক তাই নারী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে একটু হ্যারেস হতে হয়। নারীদের যেই সম্মানের জায়গাটা সেটা আমাদের সমাজে এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, সারাবছর চাহিদা সম্পন্ন বাটিকে এখন অনেক নতুনত্ব এসেছে, যা মুগ্ধ করে সবাইকে। গুণে এবং মান ধরে রাখতে পারলে এই পণ্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেক। দেশের বাইরে প্রবাসী বাঙালির কাছে অনেক চাহিদা থাকলেও কুরিয়ার জটিলতায় তা সবসময় পৌছানো সম্ভব হয় না। তারপরও সঞ্চয়িতার পণ্য একটা সময় দেশের ৬৪ জেলায় পৌঁছাতে থাকলেও বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সহ ইউরোপ আমেরিকার ১৬ টি দেশে এখন পর্যন্ত পৌঁছেছে সঞ্চয়িতার মোমবাটিক। যা একজন নারীর হাত ধরে আসা রেমিট্যান্স সত্যিই আনন্দদায়ক।