বিশ্ববাজারে চলতি বছর প্রতি আউন্স (২৮ দশমিক ৩৫ গ্রাম) স্বর্ণের দাম উঠেছিল রেকর্ড ২ হাজার ৪০০ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৫ টাকা) পর্যন্ত। বর্তমানে তার চেয়ে কিছুটা কম হলেও বাজারের চড়াভাব এখনও বজায় আছে এবং যেকোনো সময় ফের আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কিংবা আশঙ্কা— উভয়ই রয়েছে।
স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকদের মতে, স্বর্ণের দামের এই নাটকীয় ঊর্ধ্বগতি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। কারণ, এর মূলে রয়েছে মূল্যবান এই ধাতুটি ক্রয় এবং সঞ্চয়ের প্রতি চীনের লাগামহীন আগ্রহ। প্রসঙ্গত, চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্যের ওঠানামার কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা থেকে চীনে স্বর্ণ ক্রয় ও সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বড় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে খুচরা পণ্য বিক্রেতা, এমনকি সাধারণ লোকজনও যে যেভাবে পারছেন— স্বর্ণ কিনছেন ও মজুত করছেন। তাদের এই আগ্রহের প্রধান কারণ ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
আন্তর্জাতিক বাজারে এতদিন পর্যন্ত যুগপৎভাবে স্বর্ণের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল চীন ও ভারত। কিন্তু গত বছর চাহিদার নিরিখে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে চীন। ২০২৩ সালে শতকরা হিসাবে যেখানে চীনা ক্রেতাদের মধ্যে স্বর্ণালঙ্কার কেনার প্রবণতা বেড়েছে ১০ শতাংশ, সেখানে ভারতীয় ক্রেতাদের মধ্যে স্বর্ণের অলঙ্কার কেনার প্রবণতা কমেছে ৬ শতাংশ।
স্বর্ণালঙ্কার কেনার প্রবণতার পাশাপাশি স্বর্ণকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে বিনিয়োগের হারও বেড়েছে চীনে। ব্লুমবার্গের হিসাব বলছে—২০২৩ সালে স্বর্ণের মাধ্যমে বিনিয়োগের হার চীনে বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
সামনের বছরগুলোতে অর্থের পরিবর্তে স্বর্ণের মাধ্যমে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের প্রবণতা চীনে আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন হংকংভিত্তিক বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিলিপ ক্ল্যাপউইজিক।
আমদানিতে উল্লম্ফণ
অভ্যন্তরীণভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ হলেও চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে স্বর্ণ আমদানির মাত্রাও ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে চীন। গত দুই বছরে ২ হাজার ৮০০ টনেরও বেশি স্বর্ণ আমদানি করেছে চীন, যা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে থাকা স্বর্ণের মজুতের এক তৃতীয়াংশের সমান।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত যে পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি করেছে বেইজিং, তা গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্য পিপলস ব্যাংক অব চায়না টানা ১৭ মাস ধরে স্বর্ণ কিনছে। আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও স্বর্ণ কিনছে পিপলস ব্যাংক অব চায়না। ২০২৪ সাল জুড়েও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চীনের ক্রেতাদের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, যখন স্বর্ণের দাম বাড়বে তখন তা কেনা বন্ধ রাখা এবং যখন দাম কমবে— তখন ফের কেনা শুরু করা।
চীনের সরকার অবশ্য সম্প্রতি একটি বিবৃতি জারি করে বেসরকারি বিনিয়োগকারী ও সাধারণ ক্রেতাদের সতর্কবার্তা দিয়েছে। সেই বার্তায় বলা হয়েছে, ক্রেতারা যদি তাদের চাহিদায় লাগাম না টানেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতিতে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।