ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় অভিযুক্ত গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকা আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানের প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট বলেছেন, এনবিআরকে আইন মেনে ব্যাংক চলাকালীন সময়ের মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। আদালত একইসঙ্গে এনবিআরকে তাদের দাবিনামা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের বরাবর পাঠাতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি আরও ৪৮ ঘণ্টার জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছেন আদালত।
রোববার (৫ মে) বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের হাইকোর্টের একক কোম্পানি বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী। ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আনিতা গাজী রহমান এবং উল্কা গেমস লিমিটেডের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুন সালেহীন।
এর আগে ৩০ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় গ্রাহকের পাওনা টাকা আদায়ে এনবিআরের অভিযান পরিচালনার প্রেক্ষাপটে ১ মে ছুটির দিনেও আদালত পরিচালনা করা হয়। ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দুটি কোম্পানির আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ বসেন।আদালতে সেদিন ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকার পরও কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়ে এনবিআরের ১৫ জনের টিম রাতভর অভিযানের নামে তল্লাশি চালায়। তারা ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের আটকে রাখেন। ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা হিসাব ফ্রিজ থাকার বিষয়টিও আদালতে উপস্থাপন করেন।
পরে হাইকোর্ট রোববার (৫ মে) পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেন। এ ছাড়া, মামলায় এনবিআরকে পক্ষভুক্ত করেন।
গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিআরের চেয়ারম্যানের লিখিত অনুমোদনপত্র নিয়ে কর অঞ্চল-১৫ এর দুজন ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের টিম মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বেলা ১১টা থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত গ্রাহকের কাছে সরকারের পাওনা টাকা আদায়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু আদালতে চলমান মামলার অজুহাত তুলে শেষ পর্যন্ত টাকা ছাড় করেনি ব্যাংকের গুলশান শাখা।
পরে এনবিআর কর্মকর্তারা লিখিত ব্যাখ্যা নিয়ে গুলশান শাখা ত্যাগ করেন। যদিও এনবিআর কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে যে মামলার বিষয় ও এনবিআরের পাওনা কর সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের পাওনা ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় বিশেষ টিম পাঠায় কর অঞ্চল-১৫। উল্কা গেমস লিমিটেড নামের একটি অনলাইন জুয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগে দুই বছর আগে তদন্ত শুরু করে এনবিআরের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইসি। টাকা নিয়ে কোম্পানিটি যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য উল্কা গেমসের ব্র্যাক ব্যাংকে থাকা ৫৩ কোটি টাকা ফ্রিজ করে সিআইসি। তদন্তে প্রায় ৫০ কোটি টাকা কর ফাঁকির প্রমাণ পায় সংস্থাটি।
তিনি আরও বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সরকারের পাওনা আদায়ে এনবিআরের একটি বিশেষ টিম অভিযানে যায়। কিন্তু ওই কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের মধ্যে মামলা চলমান রয়েছে, এ অজুহাতে টাকা ছাড় করতে রাজি হয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এনবিআরের পাওনার সঙ্গে ওই মামলার কোনো যোগসাজশ নেই। করের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। সে কারণে এনবিআর চেয়ারম্যানের লিখিত অনুমোদন নিয়েই রাজস্ব আদায় করতে যায় বিশেষ টিম।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার রশীদ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাংকে থাকা টাকা নিয়ে মামলা চলছে উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের মধ্যে। মামলার জেরে এই টাকা লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এনবিআর ওই টাকা পাবে কি না, সে বিষয়ে শুনানি হবে আগামী ৫ মে। আদালতের সিদ্ধান্তের পরই টাকা ছাড় করা হবে।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা যায়, ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা হিসাব ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ফ্রিজ করা ছিল। সিআইসির কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেতে পারে। সে কারণে হিসাব সচল করে টাকা আদায়ে কর অঞ্চল-১৫ কে নির্দেশনা দেয় সিআইসি। আদেশ পেয়ে গুলশান শাখায় যান কর্মকর্তারা। তবে, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ প্রায় ১৩ ঘণ্টা ব্যাংকে অবস্থান করেও টাকা ছাড়াই শাখা ত্যাগ করতে বাধ্য হন কর কর্মকর্তারা।
টাকা না পেলেও লিখিত ব্যাখ্যা নিয়ে যান কর অঞ্চল-১৫ এর কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে এনবিআর মনে করছে— ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে
কর অঞ্চল-১৫ এর ডেপুটি কমিশনার ফজলুল ইসলাম বরাবর দাখিল করা এক পত্রে পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক হাসান মাহমুদ।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ব্র্যাক ব্যাংকের আইনি বিভাগ থেকে আমরা মতামত নিয়েছি। সেখানে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আদালতের ইস্যু করা কোম্পানির মামলার বিষয়টি বলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনায় ব্র্যাক ব্যাংক তাদের কাছে রক্ষিত উল্কা গেমস লিমিটেডের অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করা হয়েছে। আদেশপ্রাপ্তির পর ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি আরও একটি কোম্পানির পক্ষ থেকেও আবেদন পায়। আদালতের শুনানির পর ওই আবেদনটিও মঞ্জুর করা হয়েছে।
ব্যাংক আবেদন পর্যালোচনা করে তাদের পুরো বিষয়টি অবগত করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে— ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর এনবিআর সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) নির্দেশনায় হিসাবটি ফ্রিজ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। ৫ মে এ বিষয়ে আদালতের কোম্পানি কোর্ট নং ২৬ এর ১৩ নম্বর আইটেম হিসেবে শুনানি হবে। যেহেতু বিষয়টি এখনও বিচারাধীন এবং উল্লিখিত ইস্যুটি ৫ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। বিচারাধীন বিষয়টি নিয়ে আমরা পে-অর্ডার দিতে পারি না। এ জাতীয় অনুরোধ গ্রহণ করার অবস্থানে নেই। কারণ, এটি আদালত অবমাননার দিকে নিয়ে যেতে পারে।