‘ওর একটা শখ ছিল, এভারেস্ট জয় করবে। ধীরে ধীরে সে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে গেছে। ইনশল্লাহ আমার ছেলে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। এটা বাবা হিসেবে আমার জন্য খুবই আনন্দের, উল্লাসের এবং খুশির বিষয়। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।’
রোববার (১৯ মে) দুপুরে গণমাধ্যমকে কথাগুলো বলতে বলতে আনন্দ অশ্রু বইছিল এভারেস্ট জয় করা বাংলাদেশের পর্বতারোহী বাবর আলীর বাবা লিয়াকত আলীর চোখে। লিয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান বাবর আলী। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে চিকিৎসক হবে। ছেলে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। কিন্তু সেই পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে হাঁটলেন না ছেলে। বরং হাঁটতে শুরু করলেন পাহাড়-সমতলের দুর্গম পথে পথে। হাঁটতে, হাঁটতে বাবর আলী স্বপ্ন দেখলেন এভারেস্ট জয়ের।
বাবর আলীদের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর গ্রামের নজু মিয়া হাট এলাকায়। বাবা লিয়াকত আলী কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। মা লুৎফুন্নাহার বেগম গৃহিণী।
তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে বাবর দ্বিতীয়। বড় ভাই ব্যারিস্টার, অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। দ্বিতীয় বাবর আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এমফিল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিজিটি সম্পন্ন করেন। একমাত্র বোন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কক্সবাজার জেলা আদালতে কর্মরত। সবার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে বিকাশের মার্চেন্ট ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে আছেন।
রোববার (১৯ মে) সকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাবর আলী জানান দিলেন, তিনি স্বপ্ন পূরণ করেছেন। ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে তিনি জয় করলেন এভারেস্ট। তবে বাবরের লক্ষ্য আরও বড়, তিনি এবার জয় করতে চান পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে। সন্তানের বিজয়ে বাবরের বৃদ্ধ বাবা-মা খুশিতে আত্মহারা, একই সঙ্গে শঙ্কিতও। ছেলে ঠিকমতো শৃঙ্গচূড়া থেকে নেমে তাদের বুকে ফিরে না আসা পর্যন্ত কাটবে না এ শঙ্কা।
মা লুৎফুন্নাহার বেগম বলেন, ‘সবসময় টেনশনে ছিলাম। এখনো আছি। আমি এমনিতেই খুবই ঘুমপাগল। দিনে ১০-১২ ঘণ্টা ঘুমাতাম আমি। কিন্তু বাবর এভারেস্টের দিকে যাত্রা করার পর থেকে ঘুম আমার চোখ থেকে চলে গেছে। গত দেড় মাসে মনে হয় দিনে আমি দুই ঘণ্টাও ঘুমাতে পারিনি। নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলেছি- আল্লাহ আপনি আমার ছেলেকে সুস্থভাবে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আল্লাহ আমার ছেলেকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। আনন্দ লাগছে অবশ্যই। কিন্তু আমি তো মা। যতক্ষণ পর্যন্ত সে পাহাড় থেকে নেমে না আসবে, ততক্ষণ তো আমার টেনশন যাবে না।’
শুধু কী বাবর আলীর স্বজনরা, চট্টগ্রামও আজ আনন্দে ভাসছে তার এমন অনন্য অর্জনে। বাবরের সংগঠন ভার্টিকাল ড্রিমার্স তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে, ‘এর আগে চার বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করলেও চট্টগ্রাম থেকে বাবরই প্রথম। তাই চট্টগ্রামবাসী তার এই বিজয়ে উদ্বেলিত।’
গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এসে বাবর আলী তার এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। পরদিন ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তার এভারেস্ট জয়ের অভিযান। ৪ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডু থেকে পৌঁছান লুকলাতে। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেজ ক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। এরপর এক মাস ধরে অপেক্ষার পালা। ১৪ মে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। ওইদিনই তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছান। ১৯ মে সকালে তিনি ‘ডেথ জোন’ নামে পরিচিত ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতায় শৃঙ্গে আরোহণ করে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেন।
এভারেস্ট জয়ের আগে আরও অনেক পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন বাবর। চার হাজার ৯৮৪ মিটার উচ্চতার সারগো রি থেকে ছয় হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট আমা দাবলাম – অন্তঃত নয়টি পর্বতশৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড আছে বাবরের ভাণ্ডারে।
বাবরের আগে আরও পাঁচ বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেন। ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট।
২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে মারা যান সজল খালেদ, যিনি পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে পর্বতজয় করেছিলেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর গত ১১ বছরে আর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্টের পথ মাড়াননি। ১১ বছর পর বাবর আলী আবার লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশিদের জন্য স্বপ্নযাত্রার পথে হাতছানি দিলেন।