•অনুমোদন ছাড়াই আউটার ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণ কেন্দ্র
•দেশ-বিদেশে অবৈধভাবে ৩ হাজারের বেশি সনদ ইস্যু
•রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি দিয়ে উপাচার্যের দায়মুক্তির চেষ্টা!
দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে যেন একধাপ এগিয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এইউবি)। ২৮ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টি গুণগত শিক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে ‘সার্টিফিকেট সর্বস্ব’ শিক্ষাব্যবস্থায় মনোযোগী। দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের নামে চালিয়েছে সনদ বাণিজ্য।
সৌদি আরবে অবৈধভাবে আউটার ক্যাম্পাসও চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশ-বিদেশে আউটার ক্যাম্পাস এবং দূরশিক্ষণের নামে দীর্ঘদিন রমরমা সনদ বাণিজ্য চালিয়েছে বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সনদ বাণিজ্যের ভয়াবহ এ তথ্য। ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেখানে সনদ বাণিজ্যে উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জড়িত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব নথি পাওয়া গেছে, তাতে সনদ বাণিজ্যের স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার, ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে পাশ কাটিয়ে গুণগত শিক্ষার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় মনোযোগী। এ লক্ষ্যে দেশের আনাচে-কানাচে দূরশিক্ষণ কেন্দ্রের নামে সার্টিফিকেট ব্যবসা খুলে বসে। এমনকি দেশের বাইরে সৌদি আরবেও আউটার ক্যাম্পাস খোলে, যাতে সরকার ও ইউজিসির কোনো অনুমোদন ছিল না। এসব ক্যাম্পাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি অসংখ্য সার্টিফিকেট ইস্যু করেছে।
ইউজিসির গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যে নথি পেয়েছিলাম, তাতে প্রায় তিন হাজার অবৈধ সনদের প্রমাণ মিলেছে। সনদগুলো ইস্যু করার ক্ষেত্রে অবৈধ উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত দুজন শিক্ষকের সঙ্গে সৌদি আরবের আউটার ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা জানান, সৌদি আরবে আউটার ক্যাম্পাস ছিল। বিষয়টি জানাজানির পর ইউজিসি এ নিয়ে কৈফিয়ত চাইলে সেটা বন্ধ করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে বসে অনলাইনে নামমাত্র ক্লাস করে এক হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী সনদ বাগিয়ে নিয়েছেন। মূলত আয় বাড়াতে কর্তৃপক্ষ এ অবৈধপথে পা বাড়িয়েছিল।
সৌদিতে বসে সে সময় সনদ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর খোঁজও মিলেছে। তাদের একজন খুলনার বটিয়াঘাটার আলী আজম। তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি এইচএসসি পাস করে বিদেশ চলে আসি। এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। বেশ কয়েক বছর আগে একজনের মাধ্যমে ওখানে (এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অউটার ক্যাম্পাস) ভর্তি হয়েছিলাম। সার্টিফিকেট পেয়েছি।
তার সঙ্গে আরও অনেকে সার্টিফিকেট পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে কীভাবে ক্লাস-পরীক্ষা হতো, ভর্তি ও টিউশন ফি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি তিনি।
রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি দিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা!
ইউজিসি ছাড়াও এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সনদ বাণিজ্য নিয়ে পৃথক তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতেও সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এ নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন রেজিস্ট্রার মো. ফারুক আহমেদকে অব্যাহতি দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সনদ জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানকে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তখন শুধু রেজিস্ট্রার ফারুক আহমেদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী, মূল সনদে যৌথভাবে সই করেন উপাচার্য এবং সাময়িক সনদে সই করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এতে প্রমাণিত হয় রেজিস্ট্রার ফারুক আহমেদের একার পক্ষে সনদ জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. তারেক কুদ্দুস সনদ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, শুধু আমি নই, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কোনো কর্মকর্তা সনদ বাণিজ্য করেন না। ইউজিসি কীভাবে তদন্ত করলো, কোথায় এসব তথ্য পেলো, তা আমি বলতে পারবো না। বর্তমানে আমাদের কোনো আউটার ক্যাম্পাস চালু নেই। দেশের বাইরেও কাউকে সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা নেই।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান রেজিস্ট্রার আ ক ম এনামুল হক বলেন, সেসময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিষয়ে যতটুকু জেনেছি, তা হলো এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিল। বিষয়টি মীমাংসিত বলে মনে করি আমি।
অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস বিষয়ে তিনি বলেন, ইউজিসি নির্দেশনা দেওয়ার পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ। কাউকে না পড়িয়ে সনদ দেওয়ার মতো বাণিজ্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটি করে না। ইউজিসি তাদের প্রতিবেদনে কী তথ্য দিয়েছে, সেটা আমি বলতে পারবো না।
নামমাত্র বেতনে শিক্ষক নিয়োগ
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী- এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ১০৬ জন। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ১৩৭ জন। বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির কোনো প্রবিধানমালা নেই। ফলে নামমাত্র বেতনে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রভাষককে মাত্র ১৩ হাজার টাকা এবং অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষককে ১৯ থেকে ২৩ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। এত অল্প বেতনে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইউজিসি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আ ক ম এনামুল হক বলেন, সম্প্রতি আমরা চাকরির প্রবিধানমালা করেছি। সেটা ইউজিসিতে পাঠিয়েছি। ইউজিসি অনুমোদন দিলে প্রবিধানমালা বাস্তবায়ন করা হবে। তাছাড়া আগের চেয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতনও বাড়ানো হয়েছে। প্রবিধানমালার অনুমোদন পেলে এ সমস্যা নিরসন হবে।
এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের নানান অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করে ইউজিসি। পরে কমিটির সদস্যরা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেটি নিয়ম অনুযায়ী ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের একজন উপসচিব রোববার (১৯ মে) দুপুরে নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। কোনো বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে সেটা এখনো ওঠেনি। মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে আলোচনা করে এ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।১৯৯৬ সালে অনুমোদন পায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৩টি বিভাগ, ২৩টি কোর্স এবং ১টি ইনস্টিটিউট চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরুর সময় আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেক এককালীন টাকা অনুদান দেওয়ায় তাকে উপাচার্য ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। পরবর্তী সময়ে নিয়ম না মেনেই দীর্ঘদিন অবৈধভাবে উপাচার্য পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রাখেন তিনি। বর্তমানে তিনি উপাচার্যের দায়িত্বে না থাকলেও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তার ছেলে ড. মুহাম্মাদ জাফার সাদেক। তাছাড়া বোর্ডে সদস্য হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রী সালেহা সাদেক।