ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ধনাগোদা নদীতে
ভয়াবহ ভাঙ্গন : ঝুঁকির মুখে বিষ্ণুপুর গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার লোক ও কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ
গত ক’দিনের ঘূর্ণিঝড় রিমালের ভয়াবহ তাণ্ডব বাংলাদেশের এবং ভারতের বেশ কয়েকটি স্থানে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি ইতিহাসে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ রিমালের তান্ডব ধীরে ধীরে কমে আসলেও এখন আবার বিভিন্ন স্থানে নতুন করে শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে চাঁদপুরের ধনাগোদা নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এর ফলে ঝুঁকির মুখে বিষ্ণুপুর গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার লোক ও কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ এবং সম্পত্তি। গত ৪-৫ দিনের এই ভাঙ্গনে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের প্রায় এক শ’ মিটার এলাকা নদী গর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষার সময় এলেই এই ভাঙ্গন দেখা দেয়। বিগত ৮-১০ বছরের অব্যাহত ভাঙ্গনে এই পর্যন্ত বিষ্ণুপুর গ্রামের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ধনাগোদা নদীতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে অসংখ্য বাড়ি-ঘর, দোকানপাট এবং ফসলি জমিসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অনেক কিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অবশ্য সেই ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ধনাগোদা নদীর মাঝখানে এখন চর জেগে উঠেছে। গত ক’দিনের ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে রয়েছে বেশকিছু বসতঘর ও ফসলী জমিসহ বিপুল পরিমাণে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এবং সম্পত্তি। এতে ক্ষতির পরিমাণও কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, এতো ক্ষয়-ক্ষতির পরও অতীতে যেমন চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষের এতটুকু টনক নড়েনি তেমনি এ ব্যাপারে তাঁরা এবারও আগের মতোই থাকবেন একেবারে সম্পূর্ণ নির্বিকার। শেষ পর্যন্ত লোক দেখানো তাঁদের দৌড়ঝাঁপের পর দেখা যাবে, স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে অর্থাৎ অস্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে সামান্য কিছু জিও ব্যাগের মাটি ফেলে আগের মতোই দায় সেরেছেন।
বস্তুতঃ সুদীর্ঘ ২০-২৫ বছর পূর্বে ধনাগোদা নদীতে প্রথম ভাঙ্গন দেখা দেয়। অবশ্য সেই ভাঙ্গন তীব্র হয় ১০-১২ বছর পূর্বে। নদী ভাঙ্গন এ এলাকায় ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা। গত বছর এবং তার আগের বছর বর্ষার সময় ধনাগোদা নদীর তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙ্গন দেখা দিলে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ওই দুই বছরই সামান্য কিছু পরিমাণে জিও ব্যাগ মাটি ফেলে নদী ভাঙ্গন রোধের জন্য চেষ্টা করেন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ধনাগোদা নদীতে পানি বৃদ্ধি পায় এবং শুরু হয় ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন। বর্তমানে এই ভাঙ্গন পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে এলাকাবাসী ব্যাপক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অতি দ্রুত স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বিষ্ণুপুর নামক গ্রামের ঐতিহ্য মানচিত্র থেকে দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ১ নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ নাছির উদ্দিন খানের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ” ভাঙ্গনের খবর শুনে সাথে সাথে আমি আমার পরিষদের সদস্যদের নিয়ে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় যাই। এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নেই এবং আমার সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। প্রতিবছরের মতো এবছরও স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন রোধে অবশ্যই আমি আমার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই ঐতিহ্যবাহী ধনাগোদা নদী তীরবর্তী এলাকা বিষ্ণুপুর গ্রামে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এখন আবার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এই ভাঙ্গন ঠেকাতে হলে স্থায়ী ভাঙ্গন রোধের কোন বিকল্প নেই “।
অত্র ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার সোহেল খান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ” গত ৪-৫ দিন ধরে ধনাগোদা নদী তীরবর্তী এলাকা বিষ্ণুপুর গ্রামে নদী ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙ্গনের খবর শুনে আমিও সেখানে যাই এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। গত বছর মারাত্মক ভাঙ্গন দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ১০০ থেকে ১৫০ মিটার এলাকা জুড়ে সামান্য কিছু জিও ব্যাগ মাটি ফেলে। এ’টি কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এই ভাঙ্গন ঠেকাতে হলে অবশ্যই স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে “।
এ ব্যাপারে ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনের মহিলা মেম্বার রহিমা আক্তার মুঠোফোনে গণমাধ্যমকে জানান, ” ১ নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ৪ ও ৫ নং ওয়ার্ডের উত্তর মাথায় ভাঙ্গন কবলিত এলাকা। প্রতিবছর বর্ষা এলেই এই ভাঙ্গন শুরু হয়। আমরা স্থায়ী ভাঙ্গনরোধ চাই। চাঁদপুরের বর্তমান মাননীয় জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান ১ নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদ পরিদর্শনে এলে চেয়ারম্যান সাহেবসহ আমরা পরিষদের সকল সদস্য অত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে ধনাগোদা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনকে উল্লেখ করি। সেই হিসেবে ১ নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে চাঁদপুরের মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়কেও লিখিতভাবে আমরা অবগত করি। কিন্তু সরাসরি দায়িত্বশীল হিসেবে চাঁদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে বিষ্ণুপুর গ্রামকে ধনাগোদা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষায় অর্থাৎ স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে আজ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যা শুধু দুঃখজনকই নয়, অমানবিকও বটে “।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের স্থায়ী অধিবাসী বর্তমানে চাঁদপুরে আইন পেশায় নিয়োজিত অ্যাডভোকেট মনির ঢালী সংবাদ মাধ্যমকে মুঠোফোনে জানান, ” ঐতিহ্যবাহী মূল বিষ্ণুপুর গ্রামের এক কিলোমিটার এলাকা ইতোমধ্যে ধনাগোদা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে বর্তমানে চর পড়ে আছে। সেখানে প্রায় দেড় হাজার লোকের বসবাস ছিল। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল ঘর-বাড়ি, গাছপালা, বাগান, দোকানপাট, ফসলী জমিসহ স্থাবর, অস্থাবর অনেক কিছুই। ধনাগোদা নদীটি দীর্ঘ প্রায় ২৫-৩০ বছর পূর্ব থেকে ভাঙছে। তবে এ ভাঙ্গন গত প্রায় ১০-১২ বছর যাবত তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। অথচ এ ব্যাপারে স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দুই বছর পূর্বেও জিও ব্যাগ বালুর বস্তা ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই ভাঙ্গন ঠেকাতে হলে অবশ্যই স্থায়ী ভাঙ্গন রোধের কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বিষ্ণুপুর গ্রামে ধনাগোদা নদীর ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাই ধনাগোদা নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে হলে দ্রুত স্থায়ী ভাঙ্গন রোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক “।
এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার জন্য চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।