মাছ ও পিশাচ
মাছ ও পিশাচের কাহিনিও এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। তবে এলাকা ভেদে গল্প বলার ঢং আলাদা হয়। অনেকেই এ গল্পকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন। মূলত যারা মাছধরা অবস্থায় পিশাচের পাল্লায় পড়েছেন। তাদের মুখে উচ্চারিত গল্প এটি।
অন্ধকারে বাতি বা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চল বা টেঁটা দিয়ে খালে-বিলে যারা মাছ শিকার করে তাদের বলা হয় ডালাশিকারী। এ পদ্ধতি চাঁদপুরের পূর্বাঞ্চলে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে পুরো জেলায় এ পদ্ধতিতে মাছ ধরে অনেকে। মানুষ ডালাশিকারী হয় মূলত শখের বশে। পেশাদার ডালাশিকারি খুব কম।
বর্ষাকালে খাল ও বিলের তীরে অবস্থান করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। হাফিজুদ্দি একদিন একা মাছ ধরতে নামেন। একটা টেঁটা হাতে টর্চ লাইট আর কোমরে বাঁধা ডুলা (এক ধরনের পাত্র)। খালের তীর ধরে মাছ শিকার করতে করতে চলেছেন হাফিজুদ্দি। আজ প্রচুর মাছ পড়েছে। টাকি, কই, পুঁটি, খইলশা, শোলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। মাছ ধরছে আর ডুলায় রাখছে। মাঝে মাঝে অন্য ডালাশিকারীর সাথেও দেখা হচ্ছে।
তখন মধ্যরাত। হাফিজুদ্দি মাছ ধরার নেশায় এতই মত্ত ছিল, বুঝতেই পারেনি কখন মাঝরাত হয়ে গেছে। বর্তমানে খালের কোন জায়গায় অবস্থান করছে, তাও বুঝতে পারছে না। টর্চের আলো কমে আসছে। তিন ব্যাটারির লাইট। চার্জ মনে হয় শেষ হয়ে আসছে। লাইটের আলো দূরে গিয়ে পড়ে না।
ইতোমধ্যে যে পরিমাণ মাছ ধরা হয়েছে, তাতে ডুলা পূর্ণ হওয়ার কথা। এবার মাছের ডুলার ওপর লাইট মারে হাফিজুদ্দি। ডুলার তলায় অল্প কিছু মাছ দেখে চমকে ওঠে সে। অথচ এতক্ষণে ডুলা পুরো না হলেও কাছাকাছি হওয়ার কথা। বিষয়টি দেখে সন্দেহ হয়। কোমর থেকে ডুলা আলগা করে হাফিজুদ্দি। দেখে নেয় তলা ফুটা বা ছিদ্র আছে কি না। কিন্তু না, তলা তো ঠিকই আছে। তবে কি মাছগুলো ডুলার মুখ দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে গেছে? তা হতেও পারে, এমনটাই ভাবে হাফিজুদ্দি। আবার লাইটের আলোর কারণেও মাছ কম দেখা যাচ্ছে, এমনটাও ভাবে।
ফিরতি পথে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। হাফিজুদ্দি এবার মাছ শিকার না করে দীর্ঘ পা ফেলে। ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। একটা অজানা ভীতি দানা বাঁধে মনে। এতদিন যে পিশাচের কথা শুনে এসেছে, তা কখনো বিশ্বাস করেনি হাফিজুদ্দি। আজ কেন যেন সন্দেহ তৈরি হয়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝড়োবাতাস বন্ধ হয়ে যায়। টর্চের আলো আরও ছড়িয়ে পড়ছে। কোমরের ডুলায় একটা মাছও নেই। এবার ডুলা ভালোভাবে দেখে ডালাশিকারী। কিন্তু ডুলা পুরোপুরিই ভালো, কোনো ভাঙা বা বড় ছিদ্র নেই।
হাফিজুদ্দি বাড়ির পুকুর ঘাটে হাত-পা ধোয়। আল্লার নাম নেয় আর বুকে থু দেয়!
****
লৌহ ও গহড়ের গল্প
একসময় জমিদারদের বেশ প্রভাব ছিল বাংলার মাটিতে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেই তারা চালিয়েছিলেন রাজত্ব। চালাতেন নিরীহ প্রজাদের শাসন আর শোষণ। প্রতাপশালী এসব জমিদার ছিলেন উচ্চবিলাসী। তেমনই এক অহংকারী জমিদার ছিলেন দুই ভাই, ফরিদগঞ্জের লোহাগড়ের জমিদার ‘লৌহ’ এবং ‘গহড়’।
‘লৌহ’ ও ‘গহড়’কে নিয়ে দুটি গল্প প্রচলিত আছে। এ দুই জমিদার ভালো মানুষ ছিলেন না। কথিত আছে, একবার জনৈক ব্রিটিশ ঘোড়ায় চড়ে প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘কেমন জমিদার এরা বাপু! রাস্তাগুলো এত খারাপ। ঠিক সে সময় জমিদারদের গোলামরা এ কথা শুনে জমিদার লৌহ ও গহড়কে অবহিত করে। তৎক্ষণাৎ লৌহ ও গহড় সে রাস্তাটি সিকি ও আধুলি মুদ্রা দিয়ে ভরিয়ে দেয় এবং ওই লোকটি ফেরার পথে এ অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। পরে জমিদারদের গোলামরা তার ওপর অত্যাচার করেছিল বলে শোনা যায়। তবে সে রাস্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একদিন ‘লৌহ’ ও ‘গহড়’র মা আম-দুধ খেতে চেয়েছিলেন। এমন কথা শুনে তারা মাকে আম-দুধ খাওয়ানোর জন্য একদিন সকালে বাজারের সমস্ত দুধ ও আম এনে পুকুরে ঢেলে দিয়ে মাকে খেতে দেন। মায়ের ওপর এমন নির্যাতনের কারণে ধারণা করা হয় সেখানেই মায়ের মৃত্যু হয়। মানুষের ধারণা, প্রজা ও মায়ের অভিশাপে পতন ঘটে রাজপরিবারের। জমিদাররা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে যান সুউচ্চ পাঁচটি মঠ। যার মধ্যে এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মঠ। দুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাজি ধরে এক নারীর পেট কেটে বাচ্চা ছেলে না মেয়ে দেখেছিলেন ওই জমিদাররা।
মনসা মুড়ার বাঁশ
বাসরঘরে সর্প দংশনের পর বেহুলা মৃত স্বামী লক্ষ্মীন্দরকে নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে চলার পথে একপর্যায়ে ভেলাটি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ভুইয়ারা গ্রামে ভেড়ে। ভুইয়ারা গ্রাম এককালে উপকূল এলাকা ছিল বলে কথিত আছে। সেই ভেলায় ব্যবহৃত কাঁচা বাঁশ থেকে শিস বেরিয়ে বর্তমানের এ মনসা মুড়ার সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, একদা এক ব্যক্তি ওই বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নেওয়ার পর বাঁশ ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার স্বপ্নে দেখে যে, বাঁশ ফেরত না দিলে তার বংশের কোনো লোক বাঁচবে না। তারপরও বাঁশ ফেরত না দেওয়ায় পরে তার নাকেমুখে রক্ত বের হয়ে মারা যান। পরে তার বংশধররা ওই বাঁশ ফেরত দিয়ে আসে।
জনৈক নারী এক বিকেলে রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য এ মুড়া থেকে কিছু কঞ্চি নিয়ে রসই ঘরে রাখে। পরদিন যখন রান্না করতে রসই ঘরে প্রবেশ করতেই দেখে সাপ আর সাপ। সব সাপ একসাথে ফনা তুলে আছে। নারী এসব দেখে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে। সাপের কথা শুনে বাড়ির সবাই লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে কোনো সাপ পাওয়া গেলো না। এসময় হাঁফাতে হাঁফাতে ওই নারী বলেন, রসই ঘরে অনেক সাপ। কোথা থেকে আসছে জানি না। তবে গতকাল বিকেলে আমি মাঠের বাঁশমুড়া থেকে কিছু কঞ্চি এনে রেখেছিলাম। রান্না করতে এসে একটি কঞ্চিও দেখতে পাইনি। পুরো ঘরে সাপ আর সাপ। পরে বাড়ির লোকজন বলে ওখান থেকে নিয়ে আসা সব কঞ্চি ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে। না হয় অনেক ক্ষতি হবে। কিন্তু ওই নারী বিষয়টি সহজভাবে নিলেন না। কঞ্চি ফিরিয়ে দিলেন না। রাতে স্বপ্নে দেখেন তাকে অসংখ্য সাপ দংশনের জন্য দৌড়াচ্ছে। ভয়ে পরদিন সকালে সব কঞ্চি ওই বাঁশমুড়ায় রেখে আসে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, স্থানীয় কিছু লোক এক সাপুড়ে বহরের সাথে মনসা মুড়া থেকে সাপ ধরে দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। যখন সাপুড়ে তার ‘বিন বাঁশি’ বাজানো আরম্ভ করে; তখন বাঁশের পাতায় পাতায় ছোট ছোট সাপ গর্ত হতে উঠে আসে। সাপুড়ে একটি সাপ ধরে পাতিলে রাখার সময় কামড় দিলে তার মৃত্যু ঘটে এবং সব সাপ সাপুড়ের নৌকার দিকে যেতে আরম্ভ করলে সাপুড়ে দল সাপটি ছেড়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে কোনো সাপুড়ে এখানে সাপ ধরতে আসে না। এমনকি মাঠের মাঝে বাঁশের মুড়ার বাঁশ তো দূরে থাক একটি ঝিংলাও কাটতে কেউ সাহস পায় না।
চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার পূর্ব সহদেবপুর ইউনিয়নের ভূইয়ারা গ্রামের ফসলি মাঠের মাঝে আছে একটি বাঁশঝাড়। সময় নির্দিষ্ট করে জানা না থাকলেও এ বাঁশ ঝাড়টিকেই মনসা মুড়া বলে সবাই বিশ্বাস করে আসছে। এটি কচুয়া-সাচার সড়ক থেকে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে এবং সুন্দরী খালের উত্তর পাশে খোলা মাঠে অবস্থিত। ২১টি বাঁশ ঝাড় নিয়ে গঠিত এই মনসা মুড়াটিকে পরিকল্পিত বাগান বলে মনে হয়।এলাকার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সফল করতে এ মনসা মুড়ায় দুধ ও কলা দিয়ে থাকে মানত করে। একসময় ভুইয়ারা গ্রামের লোদ বংশীয় লোকেরা মনসা মুড়ার রক্ষণাবেক্ষণসহ পূজা-অর্চনা করতো। ১৯৬৮ সালে এই বংশের লোকজন ভারতে চলে যাওয়ার সময় পাশের মেঘদাইর গ্রামের গোবিন্দ কবিরাজের স্ত্রী যমুনা সুন্দরীকে মনসা মুড়া রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে যায়। এরপর যমুনা সুন্দরীর তিরোধানের পর তার পুত্রবধূ নীলা চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এ মনসা মুড়ায় পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সরকারি ১৯ শতক খাস ভূমির ওপর গড়ে ওঠে মনসা মুড়া। মনসা মুড়ায় নৃত্য, পূজা-অর্চনা ছাড়াও পহেলা বৈশাখে স্থানীয়দের আয়োজনে মেলা বসে।