ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ক্রেতা সংকটে প্রতিদিনই শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের পর দরপতনের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। ঈদের আগে শেয়ারবাজারের এ চিত্রে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা।
তারা বলছেন, রোজার ঈদের আগেও শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। রোজার ঈদের পর দু-একদিন বাজার ভালো গেলেও দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। শেয়ারবাজারে যখন মন্দা চলছে, সেই সময় প্রস্তাবিত বাজেটে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। ফলে বাজারে পতনের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
কয়েকদিন পরই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। শেয়ারবাজারের অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য এবারের ঈদ মাটি হয়ে যাবে। কারণ বাজারে যে হারে দরপতন হয়েছে, তাতে অনেকেই বিনিয়োগ করা পুঁজির ৫০ শতাংশের মতো হারিয়ে ফেলেছেন। বিনিয়োগকারীরা এখন চোখে সরিষার ফুল দেখছেন। সবারই দিশেহারা অবস্থা। বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায়ের দেখা মিলছে না।
গত বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থান করেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটেই ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়। শেয়ারবাজারে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা ৫০ লাখ টাকার ওপরে ক্যাপিটাল গেইন করলে তার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিতে হবে। আর ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্যাপিটাল গেইনে ট্যাক্স দিতে হবে না।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন আরোপ করা হতে পারে, এমন গুঞ্জন শেয়ারবাজারে আগেই ছড়িয়ে পড়ে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের ওপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ না করার দাবি জানানো হয়। তবে তাতে কর্ণপাত করেননি অর্থমন্ত্রী।
ফলে প্রস্তাবিত বাজেটের পর প্রথম কার্যদিবস রোববার দেশের শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবারও (১০ জুন) শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। সেইসঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।
এদিন শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে। লেনদেনের শুরুতে দেখা দেওয়া এ নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকে শেষপর্যন্ত। এমনকি লেনদেনের শেষদিকে দরপতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪২টি প্রতিষ্ঠানের। আর ২৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
ফলে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬৫ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১০৫ পয়েন্টে নেমে গেছে। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের পর সূচকটি এখন সর্বনিম্ন অবস্থা বিরাজ করছে। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্ট ছিল।
অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১০৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮১১ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৫৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ৩৮ কোটি ১২ লাখ টাকা।
বাজারের এ চিত্র সম্পর্কে বিনিয়োগকারী মিজানুর রহমান বলেন, যেই শেয়ারে বিনিয়োগ করেছি, সেটাতেই ধরা খেয়েছি। রোজার ঈদের পর থেকে গত দুই মাসে বিনিয়োগ করা পুঁজি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বর্তমানে ৭০ শতাংশের মতো লোকসানে রয়েছি। গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো লোকসানে আছি।
তিনি বলেন, লাভের আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আসল টাকা ফিরে এলেই খুশি। কিন্তু বাজারে যে হারে দরপতন হচ্ছে, তা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায় দেখছি না। এখন আমাদের দিশেহারা অবস্থা। কদিন পরেই কোরবানির ঈদ। এবার হয় তো কোরবানিই দেওয়া হবে না। এত লোকসানে তো শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব না।
মো. আলম নামের আর এক বিনিয়োগকারী বলেন, ২০-৩০ শতাংশ লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। বাজারে ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। এতে প্রতিদিন দরপতন হচ্ছে। আর লোকসানের পাল্লাভারি হচ্ছে। বাজারের এ পতন কোথায় গিয়ে থামবে, আল্লাহ জানেন। আমরা যে কি বিপদে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। লোকসানের চিন্তায় রাতে ঠিকমত ঘোমাতে পারি না।
এদিকে লেনদেন খরার বাজারে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে ওরিয়ন ফার্মার শেয়ার। কোম্পানিটির ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লাভেলো আইসক্রিমের ১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সেন্ট্রাল ফার্মা।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, ফরচুন সুজ, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেস্ট হোল্ডিং এবং ব্র্যাক ব্যাংক।অপর শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২১৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬৭টির এবং ২৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আগের কর্যদিবসে লেনদেন হয় ১০৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা।