দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে না। আমাদের দেশের কিছু মানুষজনই দেশে বিনিয়োগ করছে না, তারা বিদেশে টাকা পাচার করছে। সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর ব্যাপক সমস্যা রয়েছে। আর বাজেট সরকার দিলেও এটা কিন্তু সরকারের জন্য নয়। বাজেট হলো ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের জন্য। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের অনেক কিছু থাকলেও মানুষের জন্য কিছু নাই।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট পরবর্তী’ এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, এটা গতানুগতিক বাজেট। বাজেটের যে স্লোগান সেখানে সুখী হওয়ার কিছু নেই। গরিবদের সুখী হওয়ার মতো কিছু নেই। বড় বড় কুমড়া কারা খাচ্ছে? মানুষ ভাতের সঙ্গে কলার ঝোল খাচ্ছে। এটা হলো সুখ। পঞ্চাশ বছর হলো আমরা পতাকা, ভূখণ্ড, জাতীয় সংগীত পেলেও ভেতরের অর্থনীতির পিলার দুর্বল রয়ে গেছে।
সাবেক গভর্নর বলেন, দেশের স্বাধীনতার এত বছর পরে শুধু একটি পতাকা ও জাতীয় সংগীত পেয়েছি আমরা। কারণ এর ভেতরের অন্যান্য পিলারগুলো খুবই দুর্বল।
দেশের পুঁজিবাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ‘স্টক মার্কেট বেশ দুর্বল।, পার্শ্ববর্তী দেশের পুঁজিবাজারে সেনসেক্স বেড়ে অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। আর আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এখনো দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ব্যয় যুক্তিসংগত করতে হবে। বাজেটের আকার ছোট হয়েছে, ব্যয় কিন্তু কমেনি। বাজেটের অনেক বরাদ্দ আছে যেটা কোনো কাজে লাগবে না। হাসপাতাল করলে মেশিনপাতি থাকবে না, ডাক্তার থাকবে না। ব্রিজ করবে কিন্তু সেখানে রাস্তা নাই। কালভার্ট করবে কিন্তু রাস্তা নাই। স্কুল করবে ছাত্র থাকবে না। এসব প্রকল্প অহেতুক। এসব প্রকল্পই কালো টাকা সৃষ্টি করে। নতুন করে কিছু করার দরকার নাই। যেগুলো আছে সেগুলো সুসংহত করুন। তারপর এনবিআরের সংস্কার দরকার। এখানে জনবল না থাকলে জনবল দিতে হবে। এটা কঠিন কিছু না। এরপর জীবিকা ও ব্যবসা। এই বাজেটে এগুলোরও প্রত্যাশিত কিছু নাই। এছাড়া সংস্কার করতে হবে বাজার ব্যবস্থা ও ব্যাংক। আর ব্যবসা-বাণিজ্যির সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য দেশে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা থাকা দরকার।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। সব কিছু যে তাদের ওপর চেপে বসে আছে এমন না। তারা চাইলে কিছু একটা করতে পারে।
তিনি বলেন, উন্নত দেশ, আমরা কতটুক উন্নত, ১২৫ টি দেশের মধ্যে ১০৫। পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে ইন্টারনেটে এগিয়ে। ইন্টারনেট, মোবাইল টেলিফোন সবজায়গায় ট্যাক্স। স্পিড নেই, ব্যান্ডউইথ নেই। কীসের উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ। বাজেটে কিছু প্রায়োরিটি সেট করা দরকার ছিল। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ বড় সমস্যা। এই ৩টি বিষয়ে লক্ষ্য দেওয়া দরকার ছিল।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা লোন নেবে। এটা হলে বেসরকারি খাত ব্যবসা করতে পারবে না। পরে দেখা যাবে গুলশানের রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিড় বাড়বে। ট্যাক্স আসবে কোন জায়গা থেকে? সামর্থ্যবানদের থেকে ট্যাক্স নেন। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর বাড়ান। ভ্যাট বাড়ালে সবার ওপর এর প্রভাব পড়ে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত দুই বছরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থায় আগামী অর্থ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেশে এখন ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি চলমান। আর আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ দশদিক ৫ শতাংশ। যেটা অর্জন সম্ভব নয়। কারণ এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। আর দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। তারপর রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেট। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার বাড়ার কারণে আমাদের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। এই বছরেও ৮ শতাংশ ছিল। এছাড়া, চলতি বছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে রপ্তানির খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এক বছরে এটার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব না। একইভাবে আগামী অর্থবছরে আমদানির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত যেটা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এটাও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আগামী বছরে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়নে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে যেটা (গ্রস) ২৪ দশমিক ২ বিলিয়নে আছে। এটাও কীভাবে আসবে? কারণ রপ্তানি নেতিবাচক দিকে যাচ্ছে। আর রেমিট্যান্সও খুব ভালো না। নিচের দিকে যাচ্ছে। তারপর ডলারের বিনিময় হার যেটা গত ৫ জুনের হিসাবে ১১৭ দশমিক ৯ টাকা। সেটাকে আগামী বছরে ১১৪ টাকা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা হলে রিজার্ভ কীভাবে বাড়বে? দেখা যাচ্ছে প্রতিটি জায়গায় কোনো সামঞ্জস্য নাই। এই রকম একটা অবস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের আর্থিক খাতের আরেকটা দুর্বল দিক হচ্ছে ঋণ নির্ভরতা। দিন দিন আমাদের দায়-দেনা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালে আমাদের ঋণ দাঁড়াবে ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশে। এই বছরে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ এটাও বাড়তে থাকবে। আর ঋণ শুধু বৈদেশিক ঋণ নয়, অভ্যন্তরীণ ঋণও আছে।
তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে। সরকারের ব্যাংক নির্ভরতার কারণে ব্যক্তি খাত চাপে পড়বে। আর ইতোমধ্যেই আমরা দেখছি যে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের সংকট রয়েছে। তারল্য সংকট থাকলে প্রতিযোগিতা করে সুদের হার নির্ধারণ করার সুযোগ থাকে না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বেড়ে গেছে। এতে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা কিন্তু চাপে পড়েছে। আর বিদেশ থেকে যে সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে—প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়ন না হলে কিন্তু বিদেশ থেকেও টাকা আসবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরও কিন্তু বিদেশি অর্থ ছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করে।
ড. ফাহমিদা বলেন, অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠান আছে। এই বাজেটে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নাই। যেমন আমাদের ব্যাংকিং খাতে একটা দৈন্য দশা ও রাজস্ব আহরণে একটা দুর্বলতা ও আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা আছে। কিন্তু এই বাজেটে এগুলো সংস্কারের জন্য কিছুই দেখলাম না।
ফাহমিদা বলেন, করমুক্ত আয়সীমা মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে বাড়ানো দরকার ছিল। কর সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। এই ব্যবস্থাপনা দিয়ে সীমিত আয়ের মানুষের সমস্যা লাঘব হবে না। কালো টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এটা দিয়ে সৎ করদাতাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।