ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, দুর্নীতির বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে। দুর্নীতির মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই ‘বিশেষ কমিশন’ গঠন করুন। দুর্নীতিবাজদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও বিচার করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করুন। ঋণখেলাপি অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন।
সোমবার (২৪ জুন) জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
অধিবেশনে তিনি বলেন, আমি দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিএনপির আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। বিএনপি আমলের দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে আমাদের সেই কলঙ্ক দূর হলেও ওই সূচকে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির সম্প্রতি যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টি করছে। এ কথা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাবেক পুলিশ প্রধান ও সেনা প্রধানের দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগ মাত্র।
তিনি আরও বলেন, আমি জানি উন্নয়নের বেদনা আছে। সেই বেদনা যদি চোখের সামনে দেশের সম্পদ লুট করার কারণে হয়, তবে সেটি গ্রহণ করা যায় না। ওই লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব করা হয়, তখন সেটি সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা কেবল আশার নয়, এ প্রসঙ্গে সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত। খালেদা জিয়ার জন্য যেটা অনৈতিক, বর্তমানেও সেটি অনৈতিক। আশা করি অর্থমন্ত্রী এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে সংসদকে এর দায়ভার থেকে রেহাই দেবেন।
মেনন বলেন, এক নিষ্ঠুর অলিগার্করা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই অলিগার্কির স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য এবং খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে। এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। কিন্তু সেই লক্ষ্যে বাজেটে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না।
এই সংসদ সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, তার থেকে বাজেট প্রস্তাবনা যোজন যোজন দূরে ও সাংঘর্ষিক। বাজেটে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বৈশ্বিক সংকটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই একই বৈশ্বিক সংকটে শ্রীলঙ্কা ও ভারত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ পারছে না কেন, সে কথা বলার প্রয়োজন ছিল। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আগামী ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার আশা দিয়েছেন। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। ছয় মাস পর এই সংসদে এ ব্যাপারে পর্যালোচনা উত্থাপনের জন্য আমি প্রস্তাব করছি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়। এর ফলশ্রুতিতে যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে সর্বাপেক্ষা পীড়িত করছে, তা হচ্ছে উচ্চ দ্রব্যমূল্য। আমি সংসদে কাউকে কাউকে ঢোক গিলে বলতে শুনেছি, মানুষ কষ্টে আছে। মানুষ শুধু কষ্টে নেই, তাদেরকে সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রভাব বাজারে পড়বে না। সরকার নিজেই স্বীকার করে বাজার সিন্ডিকেট এর জন্য দায়ী। কিন্তু সেই সিন্ডিকেট ভাঙার, তাদের বিচারের আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজেটে পরোক্ষ করের যে বিস্তৃত
বোঝার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার অভিঘাত বাজারের ওপরই পড়বে। এ ক্ষেত্রে টিসিবির ডিলারশিপ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডের কথা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ গরিব মানুষের একাংশকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য তা বিশেষ কোনো ফল বহন করবে না। এ ক্ষেত্রে গণবণ্টন ও পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ধনীদের অর্জিত অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন ফাইনানশিয়াল ইনট্রিগেটি ইন্সটিটিউশন দেখিয়েছে, বছরে সাত বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগম পাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিংমল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। এই টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির যে আয় দেশে পাঠায়, তার ওপর কর বসানো হচ্ছে। তাদের বিদেশ যাত্রা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ-সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া।
এই রাজনীতিক বলেন, ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার ঋণ এখন এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। পুনতফসিলিকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ চার থেকে পাঁচ লাখ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। এই বছরের প্রথম প্রান্তিকেই ৩৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর পুরোটার কথা আগেই বলেছি। আমরা নই কেবল, একজন শিল্প উদ্যোক্তা সংসদ সদস্য টেলিভিশনে বলছেন ৪/৫ জন লোক ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে। আর ব্যাংকের নৈরাজ্য ও লুট বন্ধ করতে অর্থমন্ত্রী সংসদ কতৃর্ক পাশ করা যে ব্যাংক সংশোধন আইনের কথা উল্লেখ করেছেন, তাও একই স্বার্থে প্রণীত। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ‘ব্যাংক কমিশন’ গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত। পরের অর্থমন্ত্রী তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর এখন ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তুঘলকি কাণ্ড করছে।