প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দেশটির সঙ্গে সম্পাদিত সব ‘চুক্তি ও সমঝোতা’ বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে এই চুক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি দেবে বলেও জানান তিনি।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের কথা জানান মির্জা ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে দেশটির সঙ্গে ২টি চুক্তি, ৫টি নতুন সমঝোতা ও ৩টি চুক্তি নবায়নসহ ১০টি চুক্তি-সমঝোতা সই হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
তিনি বলেন, চুক্তিগুলো বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হওয়ায় বিএনপি এই চুক্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করছে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বিএনপি সৃষ্টি হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে। বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে আমরা ২৮ তারিখে (জুন) সংবাদ সম্মেলন করবো। এরপর আমরা প্রয়োজন হলে যে কর্মসূচি নেবো সেটা আপনারা জানতে পারবেন।
আন্দোলন ভারতের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের কথা পরিষ্কার, আমাদের এই যে বক্তব্য বা আমাদের যে আন্দোলন এটা কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নয়, এটা সরকারের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে ভারতকে রিচ করতে বা ভারতের কাছ থেকে দাবিগুলো আদায় করে নিয়ে আসতে। আপনি (সরকার) অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা না পেয়ে চুক্তি সই করতে চাচ্ছেন। তিস্তার পানি আমাদের সবচেয়ে আগে দরকার, কিন্তু তিস্তা প্রকল্পের কাজ করতে চায় সরকার। কারণ প্রকল্প হলে অনেক টাকা। সেই টাকা-ই তাদের (সরকার) আসল উদ্দেশ্য।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজ পত্রিকায় দেখলাম, পরিষ্কার করেই মমতা ব্যানার্জি বলে দিয়েছেন যে, পশ্চিমবাংলাকে বাদ দিয়ে এটা (তিস্তা চুক্তি) করা যাবে না, তারা দেবে না। এজন্য আপনাকে তো অবশ্যই চাপ প্রয়োগ করা দরকার। ফারাক্কা (পানিবণ্টন চুক্তি) তো একদিনে হয়নি, যতটুকু পাওয়া গেছে সেটা আন্দোলন করেই পাওয়া গেছে। ফারাক্কা ইস্যু দেশে-বিদেশে এমনকি জাতিসংঘে তোলা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার এসব বিষয়ে (অভিন্ন নদী-তিস্তার পানির হিস্যা) জাতিসংঘে উত্থাপন করেনি। আমরা অভিন্ন নদীর পানি পাচ্ছি না। এটাতে সমগ্র দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা থেকে… তাদের সব কিছু নির্ভর করে এসব নদীর ওপরে। কোটি কোটি মানুষ এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তা এসব নদীর অববাহিকায় বাস করে। তাদের মাছ ধরা, পানি আনা সবকিছু নির্ভর করে এসব নদীর ওপরে…. সেখানে এসব নদীর পানির হিস্যার ব্যাপারে কোনো কথাই নেই। দেখবেন এসব চুক্তিতে কোথাও এই হিস্যা নিয়ে একটা কথাও নেই। এটা থেকে বুঝতে পারা যায় আসলে এই সরকার দেশপ্রেমিক সরকার নয়, বাংলাদশবিরোধী একটা সরকার।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার থেকে সরে যায়নি বিএনপি
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা কোনো আন্দোলন থেকে সরে যাইনি। বিএনপি গত ১৫/১৬ বছরে যেসব আন্দোলন করেছে, এসব আন্দোলন খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে কয়েকশ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, এই আন্দোলনে ২২/২৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, ২৭ হাজার লোককে দুইদিনে গ্রেফতার করা হয়েছে… এই ভয়াবহ সরকারের যে নিবর্তনমূলক, নির্যাতনমূলক দমননীতি- এ কারণেই হয়তবা সাফল্য আসেনি এখন পর্যন্ত। কিন্তু কোনোদিনই ন্যায়ের পথে আন্দোলন ব্যর্থ হয় না, আমাদের এটাতেও অবশ্যই সাফল্য আসবে।
তিনি বলেন, আমরা কখনো আন্দোলন থেকে সরে যাইনি। বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রতীক, তাকে মুক্ত করার অর্থ প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্র মুক্ত করার মতোই। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেকে সরে যাইনি, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন থেকে সরে যাইনি… এটা বাস্তবতা। দুই আন্দোলনকে আলাদা করে দেখা যাবে না।
ভারতের সঙ্গে চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ কী, প্রশ্ন ফখরুলের
বিএনপি মহাসচিব বলেন, চিকেন নেকটাকে (শিলিগুড়ি করিডোর) বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর তৈরি করা- এতে বাংলাদেশের লাভ কী? কোথায় লাভ বলতে পারেন? সম্পূর্ণ লাভ তার (ভারতের)।
তিনি বলেন, এটা ভারত বিরোধিতা নয়, আমাদের প্রশ্ন আমাদের স্বার্থে। দরকার কখনো বন্ধ হবে না, খোলা থাকবে। কানেকটিভিটি আমার স্বার্থে হতে হবে, আমার স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে হবে না। আমার নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি হবে না।
সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনি অভিন্ন নদীর পানির ব্যাপারে কোনো কিছুই করছেন না। সীমান্তে মানুষ হত্যা করছে… আপনি কিছুই বলছেন না। আপনি কী করেছেন? চুক্তি করেছেন। এই চুক্তিতে এসব বিষয়ে একটা কথা আছে… একটাও নেই।
তিনি আরও বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, একজন দেশপ্রেমিককে তার দেশের স্বার্থ আগে দেখতে হবে।এসময় ২৪ জুন অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের বিষয়ে কথা বলেন মির্জা ফখরুল। বৈঠকে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, সীমান্ত হত্যা, কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত রেল যোগাযোগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগের সমঝোতা, কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা, ওষুধ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতের অবাধ বিচরণ এবং ভারতের ইনস্পেস ও বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা, রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা, সমুদ্র বিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতাগুলোতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। ভারতকে সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ আদায় করতে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। এটা ম্যান্ডেট বিহীন সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ।