সশস্ত্র বাহিনীকে সেনা ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংকটকে সামরিক রূপায়ণের অপচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন তারা।
রোববার (৪ আগস্ট) রাজধানীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা তুলে ধরেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া।
মূল বক্তব্যে ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটা দেশবাসী দেখেছেন। এর কোনো কিছুই মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা নয়। প্রথমপক্ষ অর্থাৎ, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সারা দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণরা শত উসকানি, হামলা নির্যাতনের মধ্যেও ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে আস্তে আস্তে আইন মেনে সামনে পা বাড়াচ্ছিল। বিপরীতে দ্বিতীয়পক্ষ উপুর্যপরী উসকানি দিলো, গুন্ডা-পাণ্ডা দিয়ে সন্ত্রাস চালালো এবং পুলিশ, র্যাব, বিজিবি নামিয়ে; আকাশে হেলিকপ্টার উড়িয়ে নির্বিচারে গুলি করে অগণিত শিশু, কিশোর, তরুণের তাজাপ্রাণ হরণ করলো, তা দেশের মানুষ কি এত সহজে এবং অল্প সময়ে ভুলে যাবে?
তিনি বলেন, আক্রমণকারীরা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিরোধের মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হলো। পরবর্তীপর্যায়ে ব্যবহার করা হলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে। তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কখনও সম্মুখভাবে, কখনও পেছনে, কখনও পাশে দাঁড় করিয়ে অন্যান্য বাহিনীগুলো এ গণআন্দোলনের ওপর তাদের জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে এমন পরিস্থিতির দায় দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর নেওয়া উচিত নয়।ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, করুণ, মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটতো না। এসব হামলা, আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছেন বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ। অসহায় নাগরিকরা প্রয়োজনীয় এবং জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার ওপরে চলছে ব্লক রেইড। সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়িঘর, মেস চিনিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনাও চলছে। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী।সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে দেশের এমন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না। সমগ্র দেশটা, প্রিয় রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে দিতে পারি না। আজ এখানে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, তা আমরা করতে দেবো না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকবো।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অতীতে কখনও দেশবাসী বা জনসাধারণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। তাদের বুকে বন্দুক তাক করেনি। একটি রাজনৈতিক সংকটকে সামরিক রূপায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আমরা সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তীব্র বিরোধিতা করছি। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সামরিক সরকারের এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত সম্পদশালী দেশটিকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শাসকদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে।
ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, উদ্ভূত এ রাজনৈতিক সংকটকালে আমরা রাজপথ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের সীমান্ত এ মুহূর্তে অরক্ষিত। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন দমনে সীমান্ত থেকে উল্লেখযোগ্য বিজিবি সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে অবিলম্বে সেনা ছাউনিতে ফিরিয়ে এনে আপদকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, ‘বৈষম্য, ভেদাভেদ ও জুলুমের অবসান করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। তা না ঘটে উল্টো এটা আজ দেশের সব পর্যায়ে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিচের স্তরে পড়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও এর ব্যবস্থাপনা খুব নাজুক, যার প্রতিকার ঘটাতে জনগণ আজ আত্মোৎসর্গ করতে পিছপা হচ্ছে না। এমন কষ্টকর পরিস্থিতির ভেতর দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, বিচারের মাধ্যমে তাদের সাজা নিশ্চিত করে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না।’সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বক্তব্য দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খানসহ ছয়জন সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বক্তব্য দেন। এ সময় অন্যদের আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান।