সচেতনতার অভাবে বাড়ছে দুরারোগ্যব্যাধি থ্যালাসেমিয়া। যার কারনে প্রতিবছর রক্তের অভাবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা। চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে প্রতিমাসে গড়ে অন্তত অর্ধশাতাধিকেরও বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী হাসপাতালে রক্ত দিতে গিয়ে থাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, গত ৬ মাসে সরকারি হাসপাতালের শুধুমাত্র শিশু বিভাগেই প্রায় দুই শতাধিক থ্যালাসেমিয়া শিশু রোগীরা রক্ত নিতে এসেছেন। এছাড়া পুরুষ বিভাগে এবং মহিলা বিভাগেও প্রতিমাসে রক্ত নেয়ার জন্য অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগীরা আসেন।
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রারের তথ্য থেকে জানাগেছে , থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ওয়ার্ডে চলতি বছরের জানুয়ারি সর্বমোট ৪৬ জন রক্ত নিতে এসেছেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে রক্ত নিয়েছেন ৩৬ জন, মার্চে ৪৪ জন, এপ্রিলড় ৩১ জন, মে মাসে ৪৬ জন এবং জুন মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত ২৬ জন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুরা রক্ত নিতে শিশু বিভাগে এসেছেন।
এদিকে জেলার বিভিন্নস্থান থেকে হাসপাতালে রক্ত নিতে আসা কয়েকজন রোগীর অভিবাবকদের সাথে কথা বলে জানাযায়, তাদের অনেকেরই দুটি সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর কয়েক বছর বিভিন্ন ভাবে রক্ত সংগ্রহ করে তাঁদেরকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেও একসময় তারা রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরকম একাধিক অভিবাবকরা একই তথ্য দিলেন।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হাসপাতালে নিজ সন্তানকে রক্ত দিতে আসা ফরিদগঞ্জ উপজেলার ২নং বালিথুবা গ্রামের আমেনা বেগম জানান, তার ১১ বছর বয়সী ছেলে ফাহাদ দেড় বছর বয়স থেকে তেলাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। তার রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ। প্রতিমাসে রক্ত জোগার করতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। ১১ বছর আগে রক্তের অভাবে তার সাইফুল ইসলাম নামে ৯ বছর বয়সী একটি ছেলে মারা যান। সরকারি ভাবে যদি তাদেরকে রক্ত যোগারের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে তারা অনেকটা উটকৃত হতেন।
একই কথা জানালেন, একই উপজেলার পশ্চিম কোয়া গ্রামের তাসলিমা বেগম। তিনি জানান, তার দুটি সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। জাকিয়া আক্তার (১৭) ও আব্দুল করিম আড়াই বছর।
পুরান বাজার রিংকু দেবনাথ জানান. তার১২ বছর বয়সী মেয়ে মেঘা দেবনাথ দেবনাথ ৫ বছর বয়স থেকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। তারপর থেকেই মেয়েকে একমাস অথবা দুই তিন মাস পর পর রক্ত দিতে হয়।
বাবুরহাট এলাকার হাসিনা বেগম জানান, তার ১৫ বছর বয়সী ছেলে আমিন খানের প্রতিমাসে এ পজেটিভ রক্ত দিতে হয়। প্রতিমাসে তার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করতে অনেক হিমশিম খেতে হয় তাদেরকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতিনিয়িত অন্যের দান করা রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। রোগীরা নিয়মিত রক্ত নিলেও অনেক ধরনের সমস্যা হয়, ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি মেলে। তবে সেই চিকিৎসা ব্যবস্থাও দেশে গড়ে ওঠেনি। এই রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও রোগ শনাক্তে জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে আড়াই,শ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট বেড রাখার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কোন বেড না থাকার কারনে প্রতি মাসে রক্ত দিতে এসে রোগী নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় অভিবাবকদের। একই সাথে রক্ত যোগার করতে হিমশিম খেয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছেন অভিবাবকরা।
বেশ ক’জন অভিভাবক জানান, তারা যখন ডোনারদের কাছে রক্ত সংগ্রহ করে রোগীদের রক্ত দিতে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে এবং অন্যান্য ওয়ার্ডে যান, তখন রোগীকে শুইয়ে রক্ত দিতে বিছানা সংকটে বিপাকে পড়তে হয়। দেখা গেছে হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি থাকে তাদের ভিড়ে কোন বিছানা খালি পাওয়া যায়নি। তখন তারা বাধ্য হয়েই কোন রকম কষ্ট করে মেঝের বিছানায় কিংবা ভর্তিকৃত অন্য রোগীদের অনুরোধ করে তাদের বেডে শুইয়ে রোগীকে রক্ত দিতে হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোঃ আব্দুল আজিজ মিঞা বলেন, থ্যালাসেমিয়া রক্ত স্বল্পতাজনিত জন্মগত বা বংশগত রোগ। এটি জিনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যারা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তাদের মা-বাবার মাধ্যমে সন্তানের ভেতর প্রবেশ করে। এটি কোনো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। পরিবেশ থেকেও এটি ছড়ায় না। এটি জন্ম গতরোগ।
তিনি বলেন, এক বাহক যদি আরেক বাহককে বিয়ে করে, সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় যে চারজন বাচ্চার একটি বাচ্চা ডিজিজ বা মেজর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যদি বাহক আমরা নির্বাচন করতে পারি, সেই ক্ষেত্রে যদি একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করে, তখনই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।