জুয়েলারি ব্যবসায় প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্যাডমিয়াম গহনার মূল্য নিয়ে ক্রেতাদের দিচ্ছেন নিম্নমানের গহনা। এমনকি নিম্নমানের গহনা সাধারণ জুয়েলারি ব্যবসায়ীদেরও সরবরাহ করা হচ্ছে। আবার ডায়মন্ডের নাম করে ক্রেতাদের দেয়া হচ্ছে ‘মেসোনাইড’, ‘সিভিডি’, ‘ল্যাব মেইড/ম্যান মেইড’ এবং ‘এডি’ পাথরের মতো নকল ডায়মন্ড।
একটি কিনলে একটি ফ্রি অথবা এ ধরনের নানা অফারের মাধ্যমে ক্রেতাদের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা নিজের অজানতেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। কারণ, খালি চোখে সাধারণ ক্রেতার পক্ষে যেমন নকল ডায়মন্ড চেনা সম্ভব নয়, তেমন নিম্নমানের সোনাও চেনা সম্ভব নয়।
ক্রেতাদের সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ীর এ ধরনের প্রতারণার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। এজন্য সোনা এবং ডায়মন্ড কেনাবেচার ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে বাজুস। সোনায় নীতিমালা মেনে হলমার্ক নিশ্চিত করে গহনা বিক্রি, বিপণন, প্রস্তুত ও সরবরাহ করতে বলেছে দেশে সোনার দাম নির্ধাণের দায়িত্ব পালন করা এই সংগঠনটি। সেই সঙ্গে ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রির সময় বাধ্যতামূলক ক্যাশমেমোতে গুণগত মান নিদের্শক উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এদিকে জুয়েলারি ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠানে ডায়মন্ড বিক্রি করা হচ্ছে, এর বেশিরভাগ নকল। ডায়মন্ডের নাম করে ক্রেতাদের ‘মেসোনাইড’, ‘সিভিডি’, ‘ল্যাব মেইড/ম্যান মেইড’ এবং ‘এডি’ পাথর দেওয়া হচ্ছে। এসব পথর দেখতে আসল ডায়মন্ডের মতো। সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে ডায়মন্ড এবং নকল ডায়মন্ড পৃথক করা বেশ কঠিন।
তারা জানিয়েছেন, এসব নকল ডায়মন্ডের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ছাড় দিয়ে বিক্রি করেছে। কম দামে ডায়মন্ডের পণ্য পাচ্ছেন, এমন ভেবে বেশিরভাগ সময় ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। ক্রেতারা বুঝতেই পারছেন না ডায়মন্ডের মতো চকচক করলেও এগুলো আসলে ডায়মন্ড না।
ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, অবৈধ সোনা ও ডায়মন্ড বৈধ করার জন্য ২০১৯ সালের জুনে যৌথভাবে মেলা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। সে সময় ডায়মন্ড বৈধ করে ১০০-এর কম প্রতিষ্ঠান। অথচ বর্তমানে ঢাকা শহরেই হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান ‘ডায়মন্ডের পণ্য’ বিক্রি করছে। ঢাকা শহরের অলিগলির দোকানেও ‘ডায়মন্ডের পণ্য’ বিক্রি হচ্ছে।
বায়তুল মোকাররম মার্কেটের একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে বৈধভাবে ডায়মন্ড আসার পরিমাণ খুব কম। সরকারকে যথাযথভাবে শুল্ক দিয়ে ডায়মন্ড আনে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ঢাকার প্রায় সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে এখন ‘ডায়মন্ডের পণ্য’ বিক্রি হচ্ছে। আসলে ডায়মন্ডের নামে ক্রেতাদের বিভিন্ন পাথর ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব পাথর ডায়মন্ডের মতোই চকচক করে। মেশিনে দিলে টি টি শব্দ করে। সেই শব্দ শুনে ক্রেতারা মনে করেন আসল ডায়মন্ড কিনছেন। প্রকৃত পক্ষে তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ইদানিং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন দিয়ে অনলাইনে ‘ডায়মন্ডের পণ্য’ বিক্রি হচ্ছে। আসলে সবই নকল। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ছাড় দিয়ে ডায়মন্ডের পণ্য বিক্রির কথা বলছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। হয়তো কিছু ক্রেতাকে আসল ডায়মন্ড দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্রেতাই নকল ডায়মন্ড পাচ্ছেন।
মার্কেটটির আরেক ব্যবসায়ী আশরাফুল বলেন, মেসোনাইড, সিভিডি, ল্যাব মেইড/ম্যান মেইড এবং এডি পাথর দেখতে হুবহু ডায়মন্ডের মতো। এমনকি কিছু পাথর ডায়মন্ডের থেকেও বেশি চকচক করে। আলোর ছটা পড়ায় এসব পাথরকে আসল ডায়মন্ড মনে করেন অনেকে। কিছু বিক্রেতা ক্রেতাদের না জানিয়েই ডায়মন্ড বলে এসব পাথর দিয়ে দেন। আসলে যারা কম দামে ডায়মন্ডের পণ্য কিনতে চান, তারাই বেশি প্রতারিত হন।
তিনি বলেন, শুধু ডায়মন্ডের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে নয়, সোনার গহনা কেনার ক্ষেত্রেও ক্রেতাদের একটি অংশ প্রতারিত হন। কিছু ব্যবসায়ী ভ্যাট ছাড় বা মজুরি ছাড় দিয়ে সোনার গহনা বিক্রি করেন। আসলে তারাই ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এক মানের সোনা দেওয়ার কথা বলে তার থেকে কম মানের সোনা দেন। এটা ক্রেতাদের পক্ষে সহজে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সোনার গহনা কেনার ক্ষেত্রে ছাড় নেওয়ার পাশাপাশি বিক্রির রশিদে মান স্পষ্ট করে নেওয়া উচিত।
এদিকে সম্প্রতি বাজুসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ক্যাডমিয়াম গহনার মূল্য নিয়ে ক্রেতাদের নিম্নমানের গহনা দিচ্ছেন। আবার অসাধু কারিগর বা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন প্রলোভন ও অজুহাতে নিম্নমানের গহনা সাধারণ জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সরবরাহ করছেন। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা আবার সরল বিশ্বাসে ক্রেতাদের নিকট তা বিক্রি করছেন। ফলে একদিকে যেমন ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন, অন্য দিকে ব্যবসার সুনামও নষ্ট হচ্ছে।
বাজুসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, এ ধরনের নিম্নমানের গহনা প্রস্তুত, বিপণন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কোনো কারিগর বা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এ ধরনের কাজে লিপ্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ক্যাডমিয়ামের নামে নিম্নমানের কোনো গহনা প্রস্তুত, বিপণন ও বিক্রয় করা যাবে না। এ ধরনের গহনা প্রস্তুত, বিপণন ও বিক্রির সঙ্গে যারা জড়িত থাকবেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে অনেকে আছেন যারা ক্যাডমিয়াম ব্যবহার করেন না। আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা, সোনা বিক্রি করতে হলে ক্যাডমিয়াম সোনা বিক্রি করতে হবে। যদি ক্যাডমিয়াম পদ্ধতি ব্যবহার না করে সোনা বিক্রি করা হয়, তাহলে সেই সোনার মধ্যে ভেজাল আছে।
আরও পড়ুন: বিদেশ থেকে সোনা আনলে ভরিতে কর ৪০০০ টাকা
তিনি বলেন, অনেকেই ৪০-৫০ শতাংশ ছাড় দিয়ে অথবা একটা কিনলে একটা ফ্রি দেয়। তারা এসব কোথা থেকে পেলো? আমরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছি, অনেক দোকানে পাথর বিক্রি হয়। এগুলো ডায়মন্ডই না। একটা মেশিন আছে টি টি করে আওয়াজ হয়, অনেকে দেখায় এগুলো ডায়মন্ড। মেসোনাইড, সিভিডি এই দুই পাথরের কোনোটাই ডায়মন্ড না, কিন্তু মেশিনে দিলে দেখা যাবে এগুলো ডায়মন্ড। কোথায় চমকপ্রদ ছাড় আছে, ক্রেতারা সেখানে যায় এবং প্রতারণার শিকার হয়।
ক্রেতারা কীভাবে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ক্রেতারা কেনার আগে কমপক্ষে কালার এবং ক্লিয়ারিটি দেখে নিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী বৈধভাবে ডায়মন্ড নিয়ে আসছেন, তাদের সেই কাগজপত্র আছে। কিন্তু অনেকেরই কাগজপত্র নেই। তাহলে সে কোথা থেকে ডায়মন্ড আনে, সেটা কিসের ডায়মন্ড? ডায়মন্ড তো আর বাংলাদেশে হয় না। এটা বাহির থেকে আসে। তাহলে সেটা নিয়ে আসার প্রমাণ তো থাকতে হবে। এ বিষয়গুলো দেখে ক্রেতাদের ডায়মন্ড কেনা উচিত। যখন একজন ক্রেতা এগুলো দেখতে চাইবেন, তখন তার সঙ্গে প্রতারণা করার সাহস পাবে না।