সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর এরই মধ্যে অর্ধমাস পেরিয়ে গেছে। এসময়ে ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা। নিরাপদ ও লাভজনক খাতে এ অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখনো সে কার্যক্রম শুরু হয়নি।
গত ১৭ আগস্ট প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করার পর পরই প্রবাস স্কিম, প্রগতি স্কিম, সুরক্ষা স্কিম এবং সমতা স্কিমের আবেদন শুরু হয়ে যায়। উদ্বোধনের পর প্রথম দিনেই প্রায় এক হাজার ৭০০ জন নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধ করেন। প্রথম দিনেই প্রায় ৯০ লাখ টাকা চাঁদা জমা পড়ে। আর প্রথম সপ্তাহে চাঁদা পরিশোধ করেন আট হাজার ৫৫১ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ছিল চার কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
তবে প্রথম সপ্তাহে পেনশন স্কিমে যে হারে চাঁদা জমা পড়ে, দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। প্রথম ১৭ দিনে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) মোট চাঁদা পরিশোধ করেছেন ১১ হাজার ২৪৪ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ পাঁচ কোটি ৯৯ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদা পরিশোধ করেছেন তিন হাজারের কম মানুষ এবং তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কিছু বেশি।
‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা-২০২৩’-এর আওতায় রয়েছে চারটি স্কিম। যার মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য প্রবাস স্কিম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য প্রগতি স্কিম, স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম এবং স্বকর্মে নিয়োজিত স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য সমতা স্কিম। এসব স্কিমে চাঁদার হার কত হবে তা-ও নির্ধারণ করা হয়েছে।
শুরুর মতো এখনো চাঁদা পরিশোধের ক্ষেত্রে সবার ওপরে রয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে নিবন্ধন করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন পাঁচ হাজার ৬৭৪ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ তিন কোটি ২৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা।
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি যেমন- কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য চালু করা হয়েছে সুরক্ষা স্কিম। এ স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন চার হাজার ১৫৫ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৯১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
যাদের বর্তমান বার্ষিক আয়সীমা সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা তাদের জন্য চালু হয়েছে সমতা স্কিম। এ স্কিমে এখন পর্যন্ত চাঁদা দিয়েছেন এক হাজার ৮৪ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। স্কিমটির মাসিক চাঁদার হার এক হাজার টাকা। এরমধ্যে স্কিম গ্রহণকারী চাঁদা দেবেন ৫০০ টাকা এবং বাকি ৫০০ টাকা দেবে সরকার। এছাড়া প্রবাসীদের জন্য চালু করা প্রবাস স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ৩৩১ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ লাখ ৫ হাজার টাকা।
পেনশন স্কিমের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পেনশন স্কিম গ্রহণকারীদের জমা দেওয়া চাঁদার টাকা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে একটি বিনিয়োগ বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। অবশ্য বিনিয়োগ বিধিমালা তৈরির আগেও এ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ আছে।
তারা বলছেন, বিনিয়োগ বিধিমালা তৈরির আগেই পেনশন স্কিমে জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগ করা হতে পারে। তবে এ বিনিয়োগ এখনই হচ্ছে না। কারণ, তহবিলের আকার এখনো খুব একটা বড় হয়নি। তহবিলে মোটামুটি একটি বড় অঙ্ক জমা হলেই বিনিয়োগে যাওয়া হবে। আর সে অর্থের পরিমাণ কত হতে হবে, সেটির সিদ্ধান্ত সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ নেবে।
জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য নীতিমালা হচ্ছে। এটা তো খুব অল্প টাকা, আর একটু বাড়লে আমরা বিনিয়োগ করবো। নীতিমালার আগে বিনিয়োগ করতেও কোনো বাধা নেই। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগেও কোনো সমস্যা নেই। তবে আমরা চাচ্ছি টাকার অঙ্কটা আরও বাড়ুক।
আনুমানিক কত টাকা জমা হলে বিনিয়োগ শুরু হতে পারে- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখনই তা বলতে পারছি না। কারণ, এটি এককভাবে আমার ওপর নির্ভর করে না। গভর্নিং কাউন্সিল আছে, তাদের সঙ্গেও আমাদের কথা বলতে হবে। আমরা চাইবো জনগণের টাকার সর্বোচ্চ নিরাপদ বিনিয়োগ এবং ভালো রিটার্ন, এটিই হবে আমাদের নীতি।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে জমা পড়া চাঁদার টাকা নিরাপদ ও ভালো লাভজনক খাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরাও। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের সব প্রকল্প থেকে আয় আসে না। পদ্মা সেতু থেকে আয় হচ্ছে, কিন্তু অনেক প্রকল্প থেকে তো আয় হয় না। এসব বিষয়ে দেখে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সর্বজনীন পেনশন তহবিলের টাকা যেন সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বিনিয়োগ যেন লাভজনক হয় সে ব্যবস্থাও করতে হবে। বিনিয়োগ থেকে যেন অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
পেনশন স্কিমে জমা পড়া চাঁদার টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ। আমাদের স্টক মার্কেট খুবই আন্ডার ডেভেলপ। তবু অল্প কিছু স্টক আছে, যেগুলো রিলায়েবল। স্টক মার্কেটে কিছু বিনিয়োগের সুযোগ রাখা উচিত। এটি পৃথিবীর সব দেশেই রাখে। তবে এই বিনিয়োগ শুধু ট্রিপল ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিতে করার সুযোগ রাখা যেতে পারে, তার বাইরে নয়।
পুঁজিবাজারের বাইরে কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি বন্ডে করা যেতে পারে। এর বাইরে ভালো কোম্পানি যদি বাজারে বন্ড ছাড়ে, সেখানেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া সরকার যদি ভালো প্রজেক্ট নিয়ে আসে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। যেমন- দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা প্রথম পদ্মা সেতু থেকে একটা বন্ড ইস্যু করলো, যেখানে ৯-১০ শতাংশ মুনাফা দেওয়া হবে, তখন সে খাতেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারও কিছু তহবিল পেয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগটা ভালো জায়গায় না হলে চালান গায়েব হয়ে যাবে। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই ফান্ড যেন যেনতেনভাবে যে কোনো জায়গায় সরকারের ইচ্ছামতো ব্যয় করা না হয়। রিজার্ভে যেমনটি হয়েছে- এই পায়রা বন্দরকে দিয়ে দাও, অমুককে দিয়ে দাও। দিয়ে দেখা গেলো ৭ বিলিয়ন ডলার নাই হয়ে গেছে। সেটা করা যাবে না।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনারের নমিনি পেনশন স্কিম গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন।
চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে চাঁদাদাতা কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।