আজ ৮ এপ্রিল, ২০২৪ বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিবাদ্য ‘স্মার্ট স্কাউটিং, স্মার্ট সিটিজেন’। স্কাউটিং বিশ্বের একটি জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী গতিশীল অরাজনৈতিক শিক্ষামূলক, আকর্ষণীয় ও উদ্দীপনা মূলক যুব আন্দোলন। শিশু-কিশোর ও যুব বয়সীদের অবসর সময়কে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে বৈচিত্র্যময় কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন আর্দশ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্কাউটিং এক অনন্য মাধ্যম। স্কাউট আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে একজন শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুব বয়সীরা নিজের ভিতরের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আত্নোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে নিজকে নিয়োজিত করতে পারে। এই দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কাব স্কাউট, স্কাউট ও রোভার স্কাউটরা স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞার যথাযথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের ইতিহাস ও কার্যক্রম সম্পর্কে নিজে জানবে এবং অন্যকে স্কাউট আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
১৯০৭ সালে স্কাউটিংয়ের জনক রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড বেডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল ব্রিটেনের ব্রাউ›সী দ্বীপে ২০জন বালক নিয়ে স্কাউট আন্দোলনের শুভ সূচনা করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম যুব আন্দোলন হিসেবে বর্তমানে ১৭৪টি দেশের প্রায় ৫৭ মিলিয়ন শিশু, কিশোর ও যুবরা স্কাউট প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে আত্ননির্ভরশীল, পরোপকারী, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার মন্ত্রে উজ্জীবিত রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশে বয় স্কাউট সমিতি গঠিত হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১১১ নং অধ্যাদেশ বলে “বাংলাদেশ বয় স্কাউট সমিতি” সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ১লা জুন, বিশ্ব স্কাউট সংস্থা (ডঙঝগ) বাংলাদেশ স্কাউটসকে ১০৫ নং সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “বাংলাদেশ স্কাউটস”। বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটস এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ। সংখ্যার বিচার এবং গৌরব আর অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪র্থ বৃহত্তম স্কাউট দেশ। এই সংখ্যা নিয়ে আমাদের আত্নতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আরো অনেক দূরে। তাই বাংলাদেশ স্কাউটস ২০৩০ সালের মধ্যে স্কাউট সদস্য সংখ্যা ৫০ লক্ষ তৈরি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে স্ট্রাটেজিক প্ল্যান প্রস্তুত করেছে।
স্কাউটরা পতাকা স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা পাঠ করে দীক্ষা নিয়ে থাকে। এই প্রতিজ্ঞায় আল্লাহ/সৃষ্টিকর্তার প্রতি কর্তব্য পালন; দেশের প্রতি কর্তব্য পালন; সর্বদা অপরকে সাহায্য করা ও স্কাউট আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করে। স্কাউটরা তাদের প্রতিজ্ঞা ও আইন মেনে চলে এবং তাদের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটায়। ফলে স্কাউটদের মধ্যে সততা, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরোপকার ও নেতৃত্বের গুনাবলীর বিকাশ লাভ করে এবং স্কাউটদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্নিক, সামাজিক ও আবেগীয় উন্নতি সাধিত হয়। এক কথায় স্কাউটিং শিশু, কিশোর ও যুবদের সুনাগরিক হতে সাহায্য করে।
যুব সমাজের মধ্যে বয়সের তারতম্য অনুসারে চারিত্রিক বৈশিষ্ট, ও মানসিক চাহিদার পরিবর্তন ঘটে বিধায় স্কাউটিং তিনটি শাখায় বিভক্ত। কাব স্কাউট, স্কাউট এবং রোভার স্কাউট। যে সকল বালক/বালিকার বয়স ৬ বছরের বেশী, কিন্ত ১১ বছরের কম তাদেরকে কাব স্কাউট বলে। যে সকল কিশোর/কিশোরীর বয়স ১১ বছর বা তার চেয়ে বেশী, কিন্তু ১৭ বছরের কম তাদেরকে স্কাউট বলে। এবং যে সকল তরুণ/তরুণী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অথবা যাদের বয়স ১৭ বা তার চেয়ে বেশী, কিন্তু ২৫ বছরের কম তাদেরকে রোভার স্কাউট বলে। স্কাউটদের নৈতিক ও জীবনমূখী শিক্ষা দিয়ে, সেবা দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন করে দেশপ্রেমিক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবং সময়ের সাথে সাথে যুগোপযোগী স্কাউট প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রোগ্রাম বিভাগ থেকে কাব স্কাউট, স্কাউট ও রোভার স্কাউট প্রোগ্রাম প্রতিনিয়ত হালনাগাদ ও প্রণয়ন করে যাচ্ছে। আধুনিক ও উন্নত প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে মুক্তাঙ্গণে বৈচিত্র্যময় কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়, এই কর্মসূচিকে স্কাউট পদ্ধতি বলা হয়। স্কাউট পদ্ধতির ৮ টি উপাদান রয়েছে, প্রতিজ্ঞা ও আইন; হাতে কলমে শিক্ষণ; টীম সিস্টেম; ব্যক্তিগত ক্রমবৃদ্ধি; প্রতিকী কাঠামো; বয়স্ক নেতার সমর্থন; প্রকৃতি এবং কমিউনিটি ইনভলমেন্ট।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্কাউট পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ স্কাউট আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ‘স্কাউট প্রতিজ্ঞা ও আইন’ প্রতিষ্ঠিত। এর মাধ্যমে স্কাউটদের চরিত্র গঠন তথা দৃষ্টিভংগির উন্নয়ন এবং দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটানো হয়ে থাকে। স্কাউট পদ্ধতির আরেকটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে হাতে কলমে শিক্ষণ। এটি কার্যকরী শিক্ষার মৌল ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং আধুনিক শিক্ষার ‘কর্ণার স্টোন’ হিসেবে স্বীকৃত। স্কাউট পদ্ধতির অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উপাদান হচ্ছে টিম সিস্টেম। টিম সিস্টেম নেতৃত্বের বিকাশ সাধন, দক্ষতা বৃদ্ধি, দায়িত্ব সচেতনতা, একাত্নবোধ ও শৃংখলাবোধের উন্মেষ, কার্যমূল্যায়ন ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক যোগ্যতা সৃষ্টির বিশেষ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া ব্যক্তিগত ক্রমবৃদ্ধি স্কাউট পদ্ধতির অন্যতম উপাদান। এ উপাদান প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর ব্যক্তিগত উন্নয়নে তাদেরকে সচেতনভাবে ও সক্রিয়তার সাথে নিয়োজিত করতে সহায়তার করার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে তরুণ-তরুণীকে তার নিজস্ব পথে অগ্রগতিতে সামর্থ্যবান করে তোলা হয়। স্কাউট আন্দোলনের গোড়া থেকেই প্রকৃতি এবং মুক্তাঙ্গণের জীবন স্কাউট কার্যাবলীর জন্য একটি আদর্শ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল স্বয়ং প্রকৃতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং কৌতুহলীর ফলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। বালকদেরকে দেশের উত্তম নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে স্কাউটিং প্রশিক্ষণ এর প্রয়োজন আছে এবং প্রকৃতির পাঠশালাই এর উপযুক্ত স্থান।
ব্যাজ পদ্ধতি স্কাউট আন্দোলনের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এবং স্কাউট ট্রেনিং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংগ। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে দেশের স্কাউট সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মান সম্পন্ন স্কাউটিং নিশ্চিত করণের লক্ষে বাংলাদেশ স্কাউটস ব্যাজ পদ্ধতির মাধ্যমে স্কাউটদেরকে ধীর ও দৃঢ় পদক্ষেপে বিভিন্ন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে সুদক্ষ স্কাউট হিসাবে তৈরি করে। এখানে স্কাউটরা তাদের পছন্দ অনুসারে ব্যাজ নিবার্চন করে এবং ঐ ব্যাজের জন্য নির্ধারিত বিষয় অনুশীলন ও দক্ষতা অর্জন করে। ব্যাজ প্রাপ্তি স্কাউটদের যোগ্যতা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ। সর্বোপরি ব্যাজ পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টি ভংগীর উন্নয়ন সাধন করে সৎ, চরিত্রবান, আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব।
উল্লেখিত গুণগুলো অর্জন করতে ছাত্র জীবনে শিশু-কিশোর ও যুব বয়সীরা স্ব স্ব শাখার প্রোগ্রাম যথাযথভাবে সম্পন্ন করে; কাব শাখায় শাপলা কাব অ্যাওয়াড অর্জনের সুযোগ রয়েছে যা একজন কাব স্কাউটের জন্য সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর সম্বলিত সনদপত্রসহ এই অ্যাওয়ার্ড আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রদান করা হয়। স্কাউট শাখায় সর্বোচ্চ অ্যাওয়র্ড প্রসিডেন্ট’স স্কাউট অ্যাওয়ার্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ স্কাউটস এর চীফ স্কাউটের স্বাক্ষর সম্বলিত সনদপত্রসহ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রদান করা হয়। রোভার স্কাউট শাখায় প্রেসিডেন্ট’স রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ স্কাউটস এর চীফ স্কাউটের স্বাক্ষর সম্বলিত সনদপত্রসহ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রদান করা হয়। যা রোভার স্কাউটদের জন্য সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড।
এমন সোনালী অর্জনের সুযোগ ছাত্রজীবনে নিশ্চয় কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। এই অর্জন একদিকে যেমন ছাত্রজীবনকে সমৃদ্ধ করে, একই সাথে দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠতে সহায়তা করে। নিজের প্রতি কর্তব্য পালন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কর্তব্য পালন এবং অপরের প্রতি কর্তব্য পালন এই তিন মূল মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্কাউটরা। স্কাউটদের মূলমন্ত্র হচ্ছে: কাব স্কাউটদের- যথাসাধ্য চেষ্ঠা করা, স্কাউটদের- সদা প্রস্তুত এবং রোভার স্কাউটদের- সেবা। এক সাথে বলা হয় “সেবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা”। স্কাউটরা মূলমন্ত্র ধারণকরে প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা, পরিবার, সমাজ, দেশ জাতি তথা বিশ্বজনীন কল্যাণমুখিতার শুভ বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে স্কাউটিং এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্কাউটিং এ যুক্ত হলে যোগাযোগের দক্ষতা তৈরি হয়, সেই সাথে নিজের ভাবনা উপস্থাপনের কৌশলও শেখা যায়। দলের সঙ্গে কাজ করা, নেতৃত্ব দেওয়া, সময় ব্যবস্থাপনা, আত্মবিশ্বাস, ইন্টারপার্সোনাল দক্ষতাসহ বিভিন্ন দক্ষতা শিক্ষার্থীরা স্কাউটিং থেকে শিখতে পারে। স্কাউটিং কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামাজিক জড়তা দূর হয়। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, স্পষ্ট ভাষায় কথা বলাসহ যে কোন বিষয়ে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে শেখে শিক্ষার্থীরা।
স্কাউটিং নতুন প্রজন্মকে নৈতিক ও জীবনধর্মী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, এর মাধ্যমে তরুণদের মাঝে আধুনিক, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল গুণাবলী বিকশিত হয়। ফলে স্কাউট সদস্যরা সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে এবং সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছে। ২০৪১ সালের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা “স্মার্ট বাংলাদেশ” বাস্তবায়নে সহযোদ্ধা হিসেবে স্কাউটরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। স্কাউট কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে সুখি-সমৃদ্ধ ও উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিলক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে একই সাথে বাংলাদেশে তৈরি হবে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি।