দুই যুগ আগেও দেশে ভুট্টা খুব বেশি প্রয়োজনীয় ফসল ছিল না। মানুষের পাশাপাশি সামান্য পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টার চাষাবাদ হতো। সেই ভুট্টা চাষে কম সময়েই বড় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এখন দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের পরেই একটি ব্র্যান্ডিং ফসল হয়ে উঠেছে ভুট্টা।
দেশে এখন বৃহৎ পরিসরে ভুট্টার চাষাবাদ ও বাণিজ্যিক কারবার শুরু হয়েছে। হাঁস-মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই এখন ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি বেসরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভুট্টার আটা, তেল ও ভুট্টাজাত পণ্য তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভুট্টার চাষ বাড়ছে। এরই মধ্যে ফলনেও বড় সাফল্য এসেছে। গত এক দশকে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১১ গুণেরও বেশি। গত বছর দেশে ৫৬ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫৮ লাখ টন। ২০১৫ সালে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন।
এখন ভুট্টা মাড়াই মৌসুম চলছে। ভুট্টা উত্তোলন, মাড়াই ও সংরক্ষণে ব্যস্ত কৃষকরা। ভুট্টা চাষে খরচ যেমন কম, পরিচর্যারও তেমন প্রয়োজন হয় না। সে তুলনায় লাভও বেশি। এবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টার আবাদ হয়েছে। যে কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বেশি হবে বলে মনে করেন কৃষি কর্মকর্তারা।
গত কয়েক বছরে দেশে ভুট্টার ফলনও দ্রুত বেড়েছে। বিশ্বে ভুট্টার হেক্টরপ্রতি সর্বাধিক ১১ টন ফলন হচ্ছে তুরস্কে। বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন হচ্ছে ১০ টন, যা বিশ্বে তৃতীয়। পাঁচ বছর আগেও (২০১৮ সাল) দেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন ছিল ৮ টন।
বর্তমানে দেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ টনেরও বেশি। যে কারণে ঘাটতি ভুট্টার জোগানে এখনো আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। গত বছর দেশে ২১ লাখ টন ভুট্টা আমদানি করা হয়েছে। তিন বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ টন। দেশে ফলন মৌসুমে ভুট্টা আমদানির প্রয়োজন হয় না। ভুট্টার আমদানিও দিন দিন কমছে।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সালাহ্উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, দেশে প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষও বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে ভুট্টার সর্বোচ্চ ফলনের পথে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, চাহিদা থাকার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষকরা ভুট্টার ভালো দাম পাচ্ছেন, যা তাদের চাষাবাদে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছর পর আর ভুট্টা আমদানির প্রয়োজন হবে না।
দেশে প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষও বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে ভুট্টার সর্বোচ্চ ফলনের পথে বাংলাদেশ।- ড. সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে ভুট্টা উৎপাদনের অর্ধেকই হয় রংপুর বিভাগে। উৎপাদনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ। জেলাভিত্তিক হিসেবে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভুট্টার উৎপাদন বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিনে বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ক্রমাগত ভুট্টা আবাদের জমিও বাড়ছে। গমের জায়গায় ভুট্টা চাষ করছেন কৃষকরা। চলমান রবি মৌসুমে আমাদের ভুট্টা চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর, যেখানে ভুট্টা চাষ আরও দুই হাজার হেক্টর বেশি জমিতে হয়েছে। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা মনে করছি।
তিনি বলেন, ভুট্টা ফসল কাটা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে, যা জুন পর্যন্ত চলবে। এ বছর কৃষকরা ভুট্টার ভালো দামও পাচ্ছেন বলে আমরা জেনেছি।
প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, দেশে প্রাণিখাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২-১৫ শতাংশ। এ তিন খাতে বছরে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে। মানুষের খাওয়ার উপযোগী মিষ্টি ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। পাশাপাশি কর্ন ফ্লাওয়ার, স্টার্চসহ অন্য ভুট্টাজাত প্রাণিখাদ্যের বাজারও বড় হচ্ছে।
প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নাহার অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে দেশে ভুট্টার বাজারের আকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার। তার মধ্যে দেশে ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার। আর বাকি ভুট্টা আমদানি করতে হয়।
তিনি বলেন, দেশের প্রাণিখাদ্যের বাজার এখন ভুট্টার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টা থেকে তৈরি প্রাণিখাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। দেশের তিন শতাধিক কোম্পানি এসব খাদ্য প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভুট্টা চাষ, মানুষের বিভিন্ন খাদ্য তৈরি, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতসহ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। সব মিলিয়ে দেশে এখন ভুট্টার বাজার বড় হতে চলছে।
প্রাণী খাদ্যের বাজার এখন ভুট্টার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। দেশে তিন শতাধিক কোম্পানি এসব খাদ্য প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভুট্টা চাষ, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতসহ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।- নাহার অ্যাগ্রোর এমডি রাকিবুর রহমান
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফআইএবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, দেশে ভুট্টার উৎপাদন বাড়ায় তুলনামূলকভাবে কম দামে প্রাণিখাদ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে। পাশাপাশি হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতগুলোতেও ভুট্টার ক্রেতা তৈরি হচ্ছে। ভুট্টার বাই-প্রোডাক্টেরও চাহিদা বাড়ছে।
দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান নাসির গ্রুপ এরই মধ্যে ভুট্টা থেকে স্টার্চ তৈরি করছে। পাশাপাশি আরও একটি বড় গ্রুপ কারখানা নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ দুটি গ্রুপের পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট-বড় কোম্পানি ভুট্টা থেকে মানুষের খাদ্য তৈরিতে বিনিয়োগে যাচ্ছে।
ভুট্টা থেকে স্টার্চ, ইথানল, চিনি, সিরাপ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি কাণ্ড, পাতা ও ডাঁটা থেকে কাগজ, কার্ড বা হার্ডবোর্ড, প্লাস্টিক পাইপসহ বহু শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা যায়। তবে এগুলো এখনো বাণিজ্যিকভাবে প্রসার না হলেও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট তা নিয়ে কাজ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘাসের পরিবর্তেও গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভুট্টার সাইলেজ। দৈনিক দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে এ গোখাদ্য।
গত বছর ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক দশকে (২০০৯-১৯) বাংলাদেশে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা। এরপর পাট, মাংস ও দুধ উৎপাদন। তারপরই রয়েছে কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেল শস্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ। তবে কৃষকের জীবনমানে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান উৎপাদন। গ্রামীণ কৃষকের দারিদ্র্য নিরসনেও বড় ভূমিকা রাখছে ভুট্টার চাষাবাদ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, উচ্চফলনশীল, লাভজনক ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে গমের স্থান দখল করছে ভুট্টা। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদি জমি বাড়ার হার ছিল ৪ শতাংশ। একই সময়ে গমের আবাদ কমেছে দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ভুট্টার আবাদি জমি বাড়লেও গম আবাদের জমি কমেছে দশমিক ১ শতাংশ হারে।