লক্ষ্মীপুরে প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের শহর সংযোগ সড়ক সম্প্রসারণ কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এতে জনতার রোষানলে পড়ে কাজ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদারের লোকজন। এ কাজে অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুদ্ধ সড়কটিতে চলাচলকারী লাখো মানুষ। তারা জানিয়েছেন, সওজ বিভাগ ও ঠিকাদার যোগসাজসে কাজে অনিয়ম চলছে। নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। কয়েকটি কাজ করাও হয়নি। মূলত ঠিকাদারের ইচ্ছেমতোই কাজ চলছে।
যদিও ৩.৬৫ কিলোমটার লক্ষ্মীপুর শহর সংযোগ সড়ক ও লক্ষ্মীপুর-চরআলেকজান্ডার-সোনাপুর-মাইজদী সড়ক প্রশস্তকরণ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা জনরোষে পড়ে বলছেন, চলমান এ কাজে তারাও ত্রুটি পেয়েছেন।
এদিকে প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন করতে মাঠে নেমেছেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন। রোববার (২ জুন) রাত ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহানের উপস্থিতিতে ফের কাজ শুরু হয়। এরপর রাতে ১টার দিকেও কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজটি সরজমিনে তদারকি করেন ডিসি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর আগে রোববার সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ডিসিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) এবি ছিদ্দিক, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু বৈঠক করেন। শেষে তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, সড়কটি প্রায় ৫ ইঞ্চি কার্পেটিং হবে। অনিয়মের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ তদারকির মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন হবে। বিষয়টি তারা তদারকি করবেন।
অন্যদিকে সড়কটি প্রশস্তকরণের জন্য জমি অধিগ্রহণে আবুল খায়ের নামে এক ব্যক্তিকে সার্ভেয়ারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তিনি সওজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্ভেয়ার নয়। তাকে ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ মাস্টাররুলে ট্রেসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে চাকরি স্থায়ীকরণ চেয়ে ২০১৭ সালে নিজেকে চেইনম্যান হিসেবে দাবি করে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন খায়ের। কিন্তু খায়ের নিজেকে এখন সওজ বিভাগ সার্ভেয়ার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। এতে সড়ক প্রশস্তকরণে তিনি ভূমি ও দোকান-ভবন মালিকদের কাছ থেকে কারসাজি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সড়ক ৩৬ ফুট প্রশস্তকরণের কথা হলেও কোথাও ৩১ ফুটে গিয়ে আটকে গেছে। এছাড়া বিভিন্নস্থানে ভবন অপসারণ করার কথা থাকলেও খায়েরের পকেট ভারির কারণে তা করা সম্ভব হয়নি
অভিযোগ রয়েছে, এ সড়ক উন্নয়ন কাজে লক্ষ্মীপুর সওজের তদারকি নেই। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজসে সওজ বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করছে। তবে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি, ঠিকাদারকে অনুরোধ করে তিনি কাজটি সম্পন্ন করাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের দু’পাশে ৬ ফুট করে ১২ ফুট ড্রেন নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা ৩ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও ড্রেন নির্মাণে জন্য ১৪ কোটি ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার ৯৩৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার সড়কের তমিজ মার্কেট এলাকায় পুরাতন ড্রেনের সঙ্গে নতুন ড্রেন সংযুক্ত করে দিয়েছে। সড়কটির চৌধুরী সুপার মার্কেট এলাকায় মাঝখানে বৈদ্যুতিক খুঁটি রেখেই ড্রেন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ড্রেনের নিচে সিসি ঢালাই ৪ ইঞ্চির পুরুত্বের জন্য ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও তা করাই হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে লক্ষ্মীপুর শহর সংযোগ সড়কটির দক্ষিণ তেমুহনী থেকে উত্তর তেমুহনী ও ঝুমুর থেকে সওজ কার্যালয় পর্যন্ত ২০২০ সালে ১৯ ডিসেম্বর কাজ শুরু হয়। এ কাজটি পেয়েছেন এমএম বিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও মেসার্স সালেহ আহমেদ জেবি। এর সমন্বয় করছেন ইস্কান্দার মির্জা শামীম। ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এরমধ্যে ৩ বার প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। ২০২৪ সালে এসে শহর সংযোগ (দক্ষিণ তেমুহনী-উত্তর তেমুহনী) সড়কের কাজ শুরু করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ফুটপাতের জন্য ১৭ কোটি ৮১ লাখ ১ হাজার ৬১৪ টাকা ও মাটি কাটার জন্য ধরা ছিল ২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ২৭১ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্পটিতে সড়কটি ৩৬ ফুট প্রশস্ত হবে। একই সঙ্গে সড়কের দুই পাশে ৬ ফুট করে ড্রেন নির্মাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়। সড়কে ৮০ শতাংশ পাথর ও ২০ শতাংশ বালু দেওয়ার কথা থাকলেও তার উল্টোটি করা হয়। তারা ২০ শতাংশ পাথর কমিয়ে বালু দিয়ে সাবগ্রেড তৈরি করছে। এছাড়া সাবগ্রেড তৈরির পর কার্পেটিংয়ের জন্য ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হলেও তা করা হয়নি। সাবগ্রেড তৈরির ২ দিন না যেতেই কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু করা হয়। স্থানীয় ঠিকাদার, বাজার ব্যবসায়ী ও জনগণ বিষয়টি আমলে নিয়ে শুক্রবার (৩১ মে) রাতে লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে চলমান কাজ বন্ধের জন্য দাবি তোলে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন টিপু ঘটনাস্থল উপস্থিত হন। তখন সওজ ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কেউই কোনো তথ্য উপস্থাপন করেনি। পরে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম এসে কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। এরপর থেকে দু’দিন কাজ বন্ধ ছিল।
লাহারকান্দি এলাকার বাসিন্দা ফখরুল আহাদ, সমসেরাবাদ এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন, আবির মাহমুদ জানায়, গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ যাতায়াত করে। এর উন্নয়নে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। মালামালের দাম বেশি হওয়ায় বরাদ্দ আরও বাড়বে। কিন্তু তদারকি বলতে কিছুই নেই, ঠিকাদারের ইচ্ছেমতো কাছ চলছে। এ যেন প্রকাশ্যেন ডাকাতি। আগামী ৪ বছরেও আর এ কাজে হাত দেবে না সরকার। এজন্য সিডিউল মোতাবেক কাজটি বাস্তবায়ন চাই।
জমি অধিগ্রহণে ভূমি-ভবন ও দোকান মালিকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ট্রেসার আবুল খায়ের বলেন, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। কেউ অভিযোগ দিতে পারবে না।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পটির তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী তারেক আজিজ বলেন, সড়কের কাজে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না। মানুষ না বুঝেই অভিযোগ তুলছে। নিম্নমানের কোনো পাথরও ব্যবহার করা হচ্ছে না। সড়কের বিভিন্নস্থানে এখনো ভবন অপসারণ করা হয়নি।
ঠিকাদারী কাজের সমন্বয়কারী ইস্কান্দার মীর্জা শামিম বলেন, প্রাক্কলটি ছিল ২০১৮ সালের মালামালের মূল্যে। এরমধ্যে জমি অধিগ্রহণে ২ বছর চলে যায়। এতে মালামালের দাম বেড়ে গেলে কাজে অনাগ্রহ প্রকাশ করি। এরপরও কাজ শুরু করি। কাজ করতে গিয়ে আমাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এতে কাজটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলি। পরে প্রশাসনের অনুরোধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, অনিয়মের খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থল গিয়েছি। তদারকি না থাকায় ঠিকাদারের লোকজন ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। এতে ক্ষুদ্ধ লোকজন কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল।
লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, সড়কের বিভিন্নস্থানে আমরা জমি বুঝে পাইনি। এতে ড্রেন নির্মাণে একটি স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। তবে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয়। তদন্তে (বেষ্ট অফ ওয়ান) গিয়ে কিছু ত্রুটি পাওয়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে তা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। সেসব ত্রুটি সম্পন্নের জন্যই কাজ বন্ধ করা হয়েছিল। তবে ৬ ফুটের ড্রেনে ৩ ফুট কেন, ফুটপাত থাকার কথা থাকলেও অনেকাংশে তা দেখা যাচ্ছে না এসব প্রশ্নে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে পুরাতন ড্রেনের সঙ্গে নতুন ড্রেনের সংযুক্তের ব্যাপারে তিনি বলেন, জমি নিয়ে সমস্যা থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেই কাজটি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান বলেন, অভিযোগ পেয়ে শহরে সড়ক উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে গিয়েছি। সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়েছে। সঠিক তদারকির মাধ্যমেই নির্দিষ্ট নিয়মে কাজ সম্পন্ন হবে। কোনো ধরনের দুর্নীতি করার সুযোগ নেই।