#১৩ জুলাই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
#দিনে ৫০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য পরিশোধন হবে
#৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছে
#ঢাকার ২০-২৫ শতাংশ পয়োবর্জ্য পরিশোধন করা হবে এখানে
#বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমছে
#পাগলা, মিরপুর, রায়েরবাজার ও উত্তরায় আরও চারটি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করবে ওয়াসা
জনবহুল শহর ঢাকার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ছিল না ঢাকা ওয়াসার। অধিকাংশ বাসা-বাড়ির পয়োবর্জ্য সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে যেত খাল, নদী, লেক বা ঝিলে। এতে দূষিত হতো খাল-নদীর পানি। প্রভাব ফেলতো জনজীবনে। সেই পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মাইলফলক অর্জন করতে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। নবনির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পয়োবর্জ্য পুড়িয়ে উৎপাদন করবে সিমেন্টের ফ্লাই-অ্যাশ। আর নদীতে পড়বে পরিষ্কার পানি।
দাশেরকান্দি ছাড়া আরও চারটি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ওয়াসা। এরই মধ্যে নির্মাণকাজ শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় তিন হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা ওয়াসার দাশেরকান্দি অত্যাধুনিক পরিবেশবান্ধব পয়ঃশোধনাগার। বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) এ পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি রাজধানীর আফতাবনগরের দাশেরকান্দিতে ৬২ একর জমির ওপর নির্মিত।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য পরিশোধন করা হবে। এছাড়া পরিশোধনের মাধ্যমে প্রতিদিন উৎপাদন হবে প্রায় ৪৫ টন ফ্লাই অ্যাশ (ছাই)। এরপর নর্দমা থেকে পরিশোধিত পরিষ্কার ও দুর্গন্ধমুক্ত পানি বালু নদীর পানিতে ফেলা হবে, যা নদীর পানির গুণগতমান বাড়ানোর পাশাপাশি পানি সুপেয় করে তুলবে।
বর্তমানে রাজধানীতে প্রতিদিন ১৭৫ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য তৈরি হয়। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারে তার ২০-২৫ শতাংশ পরিশোধন করা হবে। বাকি ১৪০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য ঢাকা ও চারপাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশছে। ফলে নগরীর পরিবেশ দূষণ ও বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।
সরকারের মাস্টারপ্ল্যানে ঢাকা মহানগরীকে পাঁচটি (পাগলা, দাশেরকান্দি, উত্তরা, রায়েরবাজার ও মিরপুর) ক্যাচমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। পাঁচটি প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীর শতভাগ উন্নত ও টেকসই পয়োসেবা নিশ্চিত হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
এরই অংশ হিসেবে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার রমনা থানার অন্তর্গত এলাকা মগবাজার, ওয়্যারলেস রোড, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং এলাকা, কলাবাগান, ধানমন্ডি (পূর্বাংশ), তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, তেজগাঁও এলাকা, নাখালপাড়া, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, আফতাবনগর, নিকেতন, সাঁতারকুল এবং হাতিরঝিল এলাকার সৃষ্ট পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিষ্কাশিত হওয়ার মাধ্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা হবে।
এছাড়া সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ইনটেক পয়েন্ট শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণ কমাবে। আর পাগলা পয়ঃশোধনাগারের (কলাবাগান, মগবাজার, শাহবাগ, ইস্কাটন, আরামবাগ, পল্টন, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, রামপুরা, তালতলা, বাসাবো, গোলাপবাগ, আহমেদবাগ, শহীদবাগ, গোড়ান, বেগুনবাড়ি, খিলগাঁও, পশ্চিম নন্দীপাড়া) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু হবে।
মঙ্গলবার (১১ জুলাই) দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পরিদর্শনে গিয়ে তাকসিম এ খান সাংবাদিকদের বলেন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পাঁচটি মাস্টারপ্ল্যানের একটি। চায়না যতগুলো সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট করেছে তার মধ্যে এটা বেস্ট। এটার কর্মকাণ্ড উচ্চমানের হয়েছে।
রায়েরবাজার সুয়ারেজ স্টেটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে জানিয়ে ওয়াসা এমডি বলেন, এসব প্রকল্পের সবচেয়ে বড় কাজ জমি অধিগ্রহণ করা। এই কাজটা আমাদের এগিয়েছে। উত্তরা সুয়ারেজ শোধনাগারের জমি অধিগ্রহণ করা প্রায় চূড়ান্ত। মিরপুর সুয়ারেজ স্টেটমেন্টের কাজ এগিয়ে চলছে। এটার ডিজাইন ড্রয়িং হয়েছে, ফাইনাল হয়নি।
তবে ওয়াসার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে উত্তরা, রায়েরবাজার, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জের পাগলায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হলে নদীদূষণের মাত্রা ৯০ শতাংশ কমে যাবে জানিয়ে তাকসিম এ খান বলেন, দাশেরকান্দি প্ল্যান্টে দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন মেট্রিক টন পয়ঃশোধন প্রক্রিয়ার সক্ষমতা আছে, যা রাজধানীর মোট পয়ঃশোধনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ ধরনের একক পয়ঃশোধানাগার প্ল্যান্ট দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম এবং এটিই সেরা। প্ল্যান্টটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও জনবান্ধব। বাকি চারটি প্ল্যান্ট ২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এসডিজি লক্ষ্য-৬ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার
ওয়াসা সূত্র জানায়, চীনের অর্থায়নে তিন হাজার ৪৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬২ দশমিক ২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এই অর্থের এক হাজার ১০৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা জিওবি তহবিল ও ১০ কোটি টাকা ওয়াসার তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। প্রকল্পটির বাকি দুই হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। প্রকল্পটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০ টন প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি স্লাজ ড্রাইং-বার্নিং সিস্টেম রয়েছে। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। পাওয়ার চায়নার অধীনে চেংডু ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের ডিজাইন ও নির্মিত প্রকল্পটি এক বছরের অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রকল্প অনুযায়ী, প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে একটি বর্জ্য উত্তোলন স্টেশন, রামপুরা থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ট্রাঙ্ক স্যুয়ার লাইন এবং দাশেরকান্দিতে মূল শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এখন দাশেরকান্দি শোধনাগার প্ল্যান্টে খিলগাঁও থানার অন্তর্গত আফতাবনগর সংলগ্ন এবং গুলশান (একাংশ), বনানী, তেজগাঁও, নিকেতন, মগবাজার, মালিবাগ, আফতাবনগর, বাড্ডা, কলাবাগান, পান্থপথ, ধানমন্ডি (একাংশ) ও হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার পয়ঃশোধনের ব্যবস্থা করবে। এর সুফল পাবে রাজধানীর ৫০ লাখ মানুষ।
রামপুরা সেতু এলাকা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে (আফতাবনগর আবাসিক এলাকার পূর্ব অংশে) দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। বাইরে থেকে এ পয়ঃশোধনাগার অনেকটা শিল্প-কারখানার মতো দেখায়। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, পুরো প্রকল্প এলাকায় নানান প্রজাতির ফুল, ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। সড়কসহ সবকটি স্থাপনা চকচক করছে। এর মধ্যে প্রকল্পটির অফিসের সামনে উদ্বোধনী ফলক তৈরি করা হয়েছে। সেখানে রং করছেন শ্রমিকেরা। আর প্রকল্পের মূল অংশে পয়োবর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। আবাসিক এলাকা থেকে যে লাইনে পয়োবর্জ্য আসছে, কয়েকটি প্ল্যান্টে তা শোধনের পর পরিষ্কার পানি বালু নদীতে পড়ছে। এই পানিতে দুর্গন্ধ নেই।
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মহসিন আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা হাতিরঝিল সমন্বিত একটি প্রকল্প অংশ। হাতিরঝিল করার সময় এ প্রকল্পে ডাইভারশন লাইন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে হাতিরঝিলের দক্ষিণ পাশে নির্মিত ছয়টি ও উত্তর পাশে নির্মিত ছয়টি স্পেশাল সুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচারে (এসএসডিএস) বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পয়োবর্জ্য নতুন নির্মিত এই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারে আসছে। এসব এলাকা থেকে আসা প্রায় ৫০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য শোধন করে ফেলা হচ্ছে বালু নদীতে। এতে প্রায় পাঁচটি খালসহ বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমছে।’
তিনি বলেন, পয়োবর্জ্য থেকে উৎপাদন করা ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট কারখানায় বিক্রি করা হবে। সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য ফ্লাই অ্যাশের দরকার হয়। এরই মধ্যে তিনটি সিমেন্ট কারখানা তা সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এর মাধ্যমে ওয়াসা কিছু রাজস্বও আয় করতে পারবে।’