বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবারে তাদের সপ্তম বিশ্বকাপ আসরে অংশ নিচ্ছে। ইংল্যান্ডে ১৯৯৯ সালে প্রথমবার অংশ নেয়ার পর থেকে প্রত্যেকটি বিশ্বকাপ খেলা বাংলাদেশ দলকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে এখন আর ছোট বা দুর্বল দল হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু এখনও ক্রিকেট খেলা দেশগুলো থেকে অনেক হিসেবেই বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
আইসিসি’র র্যাংকিংয়ের হিসেবে এবারের আসরের দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আট নম্বরে। তাদের নিচে রয়েছে শুধু আফগানিস্তান আর নেদারল্যান্ডস। বড় দলতো বটেই, কিছু হিসেবে র্যাংকিংয়ে নিচে থাকা এই দুই দলেরও নিচে অবস্থান বাংলাদেশের।
বোলিংয়ে বৈচিত্রের ঘাটতি, দুর্বল স্কোরিং রেট, দলীয়ভাবে বড় ইনিংস খেলার অপারগতা সহ কয়েকটি বিচারে এবারের আসরে অধিকাংশ দলের থেকে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে।
স্কোয়াডে নেই লেগ স্পিনার
এবারের বিশ্বকাপের দশ দলের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দল যাদের স্কোয়াডে কোনো লেগ স্পিনার নেই।
বাংলাদেশ দল কখনোই নিয়মিতভাবে কোনো লেগ স্পিনারের সার্ভিস পায়নি। গত দশকে দলে অলক কাপালি থাকাকালীন পার্ট টাইম লেগ স্পিন করতেন। এরপর কয়েক বছর আগে জুবোয়ের হোসেন লিখন কিছুদিন দলে খেললেও ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে না পারায় স্থায়ী হতে পারেননি।
দলে লেগ স্পিনারের অভাব এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিং প্রভাব ফেলতে পারে। এবারের আসর ভারতে হওয়ায় প্রতিটি দলই স্পিন ডিপার্টমেন্টে অন্তত একজন ডানহাতি লেগ স্পিনার বা বাঁহাতি আন অর্থডক্স স্পিনার রেখেছে।
ডান হাতি লেগ স্পিন ডিপার্টমেন্টে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডাম জাম্পা, ইংল্যান্ডে আদিল রশিদ, নিউজিল্যান্ডে ইশ সোধি, পাকিস্তানে শাদাব খান, আফগানিস্তানে রশিদ খান, শ্রীলঙ্কায় দুশান হেমন্ত আর নেদারল্যান্ডসে রয়েছেন তরুণ বোলার শারিজ আহমেদ।
দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতে ডান হাতি লেগ স্পিনার না থাকলেও দুই দলই বাঁ হাতি আন অর্থডক্স স্পিনার বা চায়নাম্যান বোলার স্কোয়াডে রেখেছেন। প্রোটিয়া স্কোয়াডে আছেন তাবরিজ শামসি আর ভারতে কুলদ্বীপ ইয়াদভ।
সবচেয়ে কম স্কোরিং রেট
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের হিসেবে এই বিশ্বকাপে সব দলের মধ্যে বাংলাদেশের দলীয় রান রেট সবচেয়ে কম। অর্থাৎ সব দলের মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতিতে ব্যাটিং করা দল বাংলাদেশ।
গত এক বছরে খেলা ওয়ানডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে খেলা ২৩ ম্যাচে গড়ে ৫.২৩ রান রেটে ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ। গত এক বছরের হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেয়া প্রতিটি দলের রান রেটই এর চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকা আফগানিস্তানের রান রেট ৫.২৯, যদিও এ বছরে বাংলাদেশের চেয়ে কম ম্যাচ খেলার কারণে এই হিসেবে এগিয়ে রয়েছে তারা।
বাছাইপর্বে দারুণ পারফর্ম করা নেদারল্যান্ডস অপেক্ষাকৃত নতুন দল হলেও আধুনিক ক্রিকেটের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে দ্রুত। এক বছরে ১৩ ম্যাচ খেলে ৫.৬৭ গড় রান রেটে ব্যাট করেছে তারা।
এই হিসেবে গত এক বছরে নেদারল্যান্ডসের চেয়ে ধীরগতিতে রান তুলেছে পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা। এই তিন দলেরই গড় স্কোরিং রেট ৫.৫ এর আশেপাশে।
আর বাকি চার দলেরই – অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত – গত এক বছরে খেলা ম্যাচে গড় রান রেট ৬ এর ওপর। অর্থাৎ আগে ব্যাটিং করলে গড়ে প্রতি ম্যাচেই তিনশো’র বেশি রান করার মত ব্যাট করে তারা।
ব্যাটার প্রতি গড় রান
কোনো দলের মোট রানকে ব্যাটসম্যানের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে প্রতি ব্যাটসম্যানের গড় রান পাওয়া যায়। এই হিসেবের মাধ্যমে ধারণা দেয়া হয় যে একটি দলের প্রত্যেক ব্যাটার গড়ে কত রান করলো।
গত এক বছরে খেলা ওয়ানডে ম্যাচের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দশ দলের মধ্যে নবম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই সময়ের মধ্যে ২৩ ম্যাচ খেলা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান প্রতি গড় রান ২৭.৪২। শুধুমাত্র আফগানিস্তানের গড় তাদের চেয়ে কম। ১৪ ম্যাচ খেলে তাদের গড় ২৬.৫৪।
বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যান প্রতি গড় রানও ত্রিশের নিচে। এ বছরে খেলা ২৫ ম্যাচে ব্যাটসম্যান প্রতি প্রায় ২৯ গড়ে রান তুলেছে তারা।
আসরের বাকি সাত দলেরই ব্যাটার প্রতি গড় ৩০ এর ওপর। আইসিসি’র সহযোগী দেশ নেদারল্যান্ডসও গত বছরে খেলা ১৩ ম্যাচে ৩১ এর বেশি গড়ে রান তুলেছে। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান প্রতি গড়ও একত্রিশের কিছু বেশি।
অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান প্রতি গড় ৩৩-৩৪ এর ঘরে আর ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান প্রতি গড় ৩৫’এর ওপরে।
টেইল এন্ডারদের ব্যাটিং গড়
টেইল এন্ডার বা বোলারদের ব্যাট হাতে রান করতে না পারার সমস্যাটা বাংলাদেশ দলে অনেকদিন ধরেই। গত এক বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখা যায়।
দলের ব্যাটসম্যান প্রতি গড় রান কম হওয়ারও অন্যতম প্রধান কারণ টেইল এন্ডারদের ব্যাটিংয়ে ব্যর্থতা।
শেষ এক বছরের পরিসংখ্যানের বিচারে টেইল এন্ডারদের রানের গড়ের হিসেবে বিশ্বকাপের দশ দলের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। এই হিসেবে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে ইংল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডস।
গত এক বছরে ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে আট উইকেট পড়ে যাওয়ার পর শেষ দুই উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের ব্যাট করতে হয়েছে ১৬ ম্যাচে। এই ১৬ ম্যাচে শেষ দুই উইকেটে দলের রানের খাতায় যোগ হয়েছে গড়ে ১৭.৫ রান।
এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে মেহেদি হাসান মিরাজ আর মুস্তাফিজুর রহমানের শেষ উইকেটে ৫১ রান বা এই সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপে নাসুম আহমেদের ব্যাটিংয়ে শেষ দুই উইকেটে ২৭ রানের জুটিগুলো দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু এই ১৬ ম্যাচের ৭ ম্যাচেই ১০ বা তার চেয়ে কম রান যোগ করে আউট হয়েছেন বাংলাদেশের শেষ দুই ব্যাটার।
গত এক বছরের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে অধিকাংশ দলের ক্ষেত্রেই শেষ দুই উইকেট জুটি বেশিরভাগ ম্যাচেই ২০ থেকে ৩০ রানের বেশি যোগ করেছে দলের স্কোরে।
এদিক থেকে সবচেয়ে ধারাবাহিক দল অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকা। গত এক বছরে খেলা ম্যাচে আট উইকেট পড়ার পর এই দুই দলের শেষ দুই উইকেট জুটি গড়ে প্রতি ম্যাচে করেছে ২৩ থেকে ২৪ রান।
আফগানিস্তান, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার শেষ দুই উইকেট জুটির ক্ষেত্রেও গড় রান প্রায় ২৩। ভারত আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে টেইল এন্ডারদের ব্যাটিং গড় ১৮ থেকে ১৯।
২৮০+ রান করার সক্ষমতার অভাব
গত এক বছরে খেলা ম্যাচে ধারাবাহিকভাবে বড় দলীয় সংগ্রহ অর্জন করার ক্ষেত্রেও বেশ ভুগতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এই সময়ের মধ্যে ১৬ ম্যাচ খেলে চার ম্যাচে ৩০০’র বেশি রান করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল।
এই চারটি ৩০০+ ইনিংসের তিনটিই এসেছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। আর অন্যটিতে প্রতিপক্ষ ছিল আফগানিস্তান।
এর বাইরে বাংলাদেশ ২৬৫-২৭৫ রান করেছে তিন ইনিংসে, যার একটি আয়ারল্যান্ড ও দু’টি ভারতের বিপক্ষে।
গত এক বছরে বিশ্বকাপের দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম সংখ্যক ৩০০+ স্কোর করেছে শুধু নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া।
নেদারল্যান্ডস এর মধ্যে ১৩টি ম্যাচ খেলে তিনবার ৩০০+ স্কোর করেছে। তবে এর মধ্যে দুটি ৩০০+ ইনিংসই তারা করেছে তাদের চেয়ে শক্তিশালী জিম্বাবুয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
নিউজিল্যান্ড এই সময়ে খেলা ২৩ ম্যাচে ৩০০+ রান করেছে তিনবার। কিন্তু এছাড়াও পাঁচ ইনিংসে ২৮০ এর বেশি রান তুলেছে তারা।
অস্ট্রেলিয়াও এই সময়ে খেলা ১৪ ম্যাচে তিনটি ৩০০+ স্কোর তুললেও দুইবার ২৮০+ রান তুলেছে।
আর গত এক বছরে ১৬ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের সমান চারটি ৩০০+ স্কোর করেছে পাকিস্তান। পাশাপাশি ২৮০’র বেশি রানও তারা তুলেছে তিনবার।
এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নয় বার ৩০০+ রান করেছে ভারত। ইংল্যান্ড করেছে ছয় বার আর দক্ষিণ আফ্রিকা পাঁচ বার।
পেস বোলিং অলরাউন্ডারের ঘাটতি
লেগ স্পিনারের মত পেস বোলিং অলরাউন্ডারের হিসেবেও এবারের আসরের অধিকাংশ দল থেকে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান বাদে প্রতিটি দলেই এক বা একাধিক পেস বোলিং অলরাউন্ডার রয়েছেন।
আধুনিক ক্রিকেটে বিশেষজ্ঞ পেসারের পাশাপাশি দলে অন্তত একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার রাখতে চায় সব দলই। এই অলরাউন্ডারের কাছ থেকে মূলত ব্যাটিংয়ে ভালো পারফরমেন্স আশা করলেও প্রয়োজনের সময় যেন বোলিংয়েও ভূমিকা রাখতে পারেন, সেটিই আশা করে থাকে দল।
র্যাংকিংয়ের হিসেবে এবারের টুর্নামেন্টে পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া। মারকুটে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে বোলিং করার সক্ষমতা রয়েছে তার।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকায় পেস বোলিং অলরাউন্ডার রয়েছেন একাধিক। অস্ট্রেলিয়ায় আছেন মিচেল মার্শ, ক্যামেরন গ্রিন আর মার্কাস স্টইনিস, ইংল্যান্ডে বেন স্টোকস আর স্যাম কুরান।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোয়াডে আছে বোলিং অলরাউন্ডার অ্যান্ডিলে ফেলুকোয়েও আর মার্কো ইয়ানসেন।
আফগানিস্তানের নাভিন উল হককেও বোলিং অলরাউন্ডার বিবেচনা করা হয়। আর ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেব আছেন ইব্রাহিম জাদরান। নিউজিল্যান্ডেও রয়েছেন জিমি নিশাম।
নেদারল্যান্ডসের ব্যাস ডি লিডের একই ম্যাচে ব্যাট ও বল হাতে পারফর্ম করার বিরল রেকর্ড রয়েছে। একই ম্যাচে ১০০ রান ও ৫ উইকেট নেয়া চার ক্রিকেটারের একজন তিনি।
তিনি ছাড়া এই কীর্তি রয়েছে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী ভিভ রিচার্ডস, ইংল্যান্ডের পল কলিংউড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রোহান মুস্তফার।
লোগান ভ্যান ডার বিকও বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে ব্যাটিং আর বোলিং দুই বিভাগেই দারুণ পারফর্ম করে দলের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিলেন।
শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক দাশুন শানাকাকে ফাস্ট বোলার বলা না গেলেও মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং করে থাকেন তিনি।