মুজিব বর্ষ উপলক্ষে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাকা ছাদবিশিষ্ট বসতঘর নির্মাণ করছে সরকার। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য বরাদ্দ করা ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়নি। অনেকের ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করে তা শেষ না করে ফেলে রাখার অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিপাকে পড়েছেন।
শরীয়তপুরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সরকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একতলা পাকা বাসগৃহ নির্মাণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য ২০২০ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এসব বাসগৃহের নাম দেওয়া হয় ‘বীর নিবাস’। ৬৩৫ বর্গফুটের একেকটি বীর নিবাসে ৪টি কক্ষ, ১টি রান্নাঘর, ২টি শৌচাগার ও ১টি বারান্দা নির্মাণ করার কথা। একেকটি বীর নিবাস নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪ লাখ ১০ হাজার ৩৮২ টাকা করে।
আমার ঘর নির্মাণ করার আগে ঠিকাদার সিরাজুল নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে আর্থিক সহযোগিতা চান। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হইনি। তিনি ঘরের কাজটি আর শুরু করেননি।
আবদুল জলিল, নড়িয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা
প্রথম পর্যায়ে জেলায় ৬৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও ২২১ বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীর নিবাস বরাদ্দ করা হয়, যার নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় বিভিন্ন ঠিকাদারকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের বীর নিবাসের নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ২০২২ সালের মে-জুনে, তা ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু শরীয়তপুরের অন্তত ৩০টি বীর নিবাসের নির্মাণকাজ এখনো শেষ করা হয়নি, ৪০-৫০ শতাংশ কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে। কয়েকটির নির্মাণকাজ এখনো শুরুই করা হয়নি।
সদর উপজেলার দক্ষিণ কেবলনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী খান ২০১৭ সালে মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী ফুলমতি বেগম ছেলের পরিবারের সঙ্গে একটি এক কক্ষের ছাপরায় বসবাস করতেন। ছেলে, ছেলের বউ ও তাঁদের দুই শিশুসন্তান থাকতেন কক্ষে, আর ফুলমতি বেগম থাকতেন ওই ছাপরার বারান্দায়। ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য একটি বীর নিবাস বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই ঘর নির্মাণের দায়িত্ব পান আবুল বাসার নামের এক ঠিকাদার। ওই ঠিকাদার ভবনটির ছাদ ও দেয়াল নির্মাণ করার পর তা ফেলে রেখেছেন। থাকার জায়গা না থাকায় নির্মাণাধীন ওই ঘরের মধ্যেই পাটকাঠির বেড়া দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী খানের স্ত্রী ফুলমতি বেগম বসবাস করছেন।
ফুলমতি বেগম বলেন, ‘আমরা তো সারা জীবন টিনের ছাপরায় কাটিয়েছি। সরকার পাকা ভবনে বসবাস করার স্বপ্ন দেখাইছে। ঘরটি অর্ধেক নির্মাণ করে এক বছর ধরে ফেলে রাখছে।’
ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছত্রমুরিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সরদার একটি ভাঙা টিনের ঘরে বসবাস করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ মানুষ, যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। সরকার বরাদ্দ দেওয়ার পরও ঘরটি নির্মাণ করা হচ্ছে না। ঠিকাদারকে তাগিদ দিয়েছি। ইউএনও মহোদয়কে অনুরোধ করেছি। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।’
নড়িয়ার চান্দনি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিলের নামের একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর নির্মাণকাজ এখনো শুরুই করা হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল বলেন, ‘আমার ঘর নির্মাণ করার আগে ঠিকাদার সিরাজুল ইসলাম ওরফে চুন্নু যোগাযোগ করেন। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে আর্থিক সহযোগিতা চান। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হইনি। তিনি ঘরের কাজটি আর শুরু করেননি।’
ঠিকাদার সিরাজুল ইসলাম ওরফে চুন্নু নড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচটি ঘরের নির্মাণকাজের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তার মধ্যে তিনটি নির্মাণ করেছি। অন্য দুটি আমি করতে চাইনি। প্রশাসন থেকে আমাকে ওই দুটি ঘর নির্মাণের অনুরোধ করেছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সমন্বয় করতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কোনো টাকা চাইনি।’
সদরের পাঁচটি ঘর নির্মাণ করছেন ঠিকাদার আবুল বাশার। তিনি ৪০-৫০ শতাংশ কাজ করে নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছেন। মুঠোফোনে আবুল বাশার বলেন, ‘আমি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। আমাকে ২৫ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। বাকি বিল না দেওয়ায় ঘরগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করতে পারিনি।’
অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন (বীর নিবাস) নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদস্যসচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। নড়িয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকটি ঘরের বরাদ্দ পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংশোধন থাকায় ঠিকাদার কাজ শুরু করেননি। কোনো ঠিকাদার কারও কাছে টাকা চেয়েছেন, এমন অভিযোগ পাইনি।’
সদরের ইউএনও মো. মাইনউদ্দিন বলেন, যে ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে রেখেছেন, তাঁদের ডেকে দ্রুত কাজ শেষ করে ঘর বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। একজন ঠিকাদার চিকিৎসার কারণে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি যদি দ্রুত কাজ না করতে পারেন, তা হলে তাঁর চুক্তি বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়ে বীর নিবাসের নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা দিলেও তার কোনো সাড়া দেননি।