ষাটোর্ধ্ব সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। শুনানি করতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের ৯ তলায় উঠেছিলেন। লিফটের সিরিয়াল পেতে দশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় তার। তীব্র এই গরমে তিনি ঠিকঠাকভাবে ৯ তলায় উঠতে পারলেও নামার সময় ঘটে বিপত্তি। লিফটে নীচ তলায় এসেও দরজা না খোলায় তিনি নামতে পারেননি। লিফটে আবার তাকে সাত তলা পর্যন্ত যেতে হয়েছে সেন্সর কাজ না করায়। শেষমেশ লিফট থেকে নামতে পেরে সৃষ্টিকর্তার শুকুর আদায় করলেন, চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ! শুধু তিনিই নন, এমন আতঙ্কে লিফটে ওঠানামা কমিয়েছেন অনেক আইনজীবী।
পুরান ঢাকায় স্থাপিত এই আদালত প্রাঙ্গণ প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে আইনজীবী-বিচারপ্রার্থী ছাড়াও বিচারকার্যে জড়িত বিচারক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশ সদস্যরা থাকেন। প্রায় সকলের কাছেই আদালত ভবনের লিফটে ওঠা মানে এক ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয়। আদালত ভবনের এসব লিফটের বেশিরভাগগুলোতে নেই সেন্সর, লিফট ম্যান। মাঝেমধ্যেই লিফটে ওঠা-নামার সময় বিকট শব্দে ঝাঁকুনি দেয়। দরজা বন্ধ করতে ম্যানুয়ালি হাত দিয়ে চাপ দিতে হয়। অনেক সময় সেন্সর কাজ না করায় নির্দিষ্ট ফ্লোরে থামে না। এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে লিফট ব্যবহার করতে হয় সবাইকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এই ভবনের তিনটি লিফট সচল থাকলেও আচরণ ভূতুড়ে। এর মধ্যে ২ নম্বর লিফটের দরজা সর্বনিম্ন ৩ বারের মতো লক-আনলক হওয়ায় পর কাজ করে। বাকি দুই লিফটের দরজা বন্ধ বা খুলতে ম্যানুয়ালি প্রেস করতে হয়।
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে লিফট আছে তিনটা। তার মধ্যে ২টার ধারণ ক্ষমতা ৭ জন করে তাও আবার সবসময় সচল থাকে না। আরেকটি লিফটে ধারণক্ষমতা ১০ এর উপরে তবে ওঠানামার গতি খুবই কম। লিফটে ফ্যান আছে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এ ছাড়া ফ্লোর নির্দেশিকা বাটনগুলোও নষ্ট হয়ে পরে আছে অনেকদিন ধরে। ফলে লিফটে উঠলে দমবন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই আদালতে বাদী ও আসামির হাজিরা, জামিনের আবেদনসহ সকল দরখাস্ত জমা দেওয়ার সময় সকাল ১০টার মধ্যে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই লেগে থাকে লম্বা সিরিয়াল, যেটি ভবনের বলয় ছেড়ে রাস্তায় এসে ঠেকে। এই সময় ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয় আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীদের। বিপাকে পড়ে যান বয়োবৃদ্ধ, নারী আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। লিফটের সিরিয়াল না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ হিসেবে ধাক্কাধাক্কি করে সিঁড়ি দিয়ে দশ তলা পর্যন্ত যেতে হয় অনেকেরই।
শুধু সিএমএম আর সিজেএম নয় ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের লিফটের অবস্থাও একই। জেলা জজ ভবনে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের জন্য লিফট রয়েছে সর্বমোট পাঁচটি। এর মধ্যে পুরান ভবনে ২টির মধ্যে একটি অচল অপরটি চালু থাকলেও ধারণ ক্ষমতা ৭/৮ জন। নতুন ভবনে ৩টির মধ্যে ১টি গত ২ মাস ধরে অচল। এ ছাড়া বাকি ২টার মধ্যে একটি মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। অপরটি সচল থাকলেও ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৮ জনের। এজন্য লিফটিতে সিরিয়াল থাকে অনেক লম্বা।
অপরদিকে মহানগর দায়রা আদালতে দুটি লিফটের একটি সচল থাকলেও ফ্লোর অনুযায়ী বাটন কাজ করে না। ফ্যান নষ্ট থাকায় তীব্র এই গরমে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। ভবনগুলোর সবগুলো লিফটই ধীরগতির ও ধারণ ক্ষমতা কম। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ ঢাকার জেলা জজ আদালতের পুরাতন ভবনের লিফট ছিঁড়ে আইনজীবীসহ ১২ জন আহত হন। ৩৯ বছর ধরে চলা আটজন ধারণক্ষমতার এই লিফটটি অতিরিক্ত লোক ওঠায় ছিঁড়ে পড়ে। বড় সেই দুর্ঘটনার পরও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের। এখনও মাঝেমধ্যেই লিফটে আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীদের আটকা পড়ার সংবাদ পাওয়া যায়।
এমনই এক ভুক্তভোগী আইনজীবী আবুল হান্নান ভূঁইয়া হৃদয় জানান, গত সপ্তাহে সিজেএম আদালতের ২ নম্বর লিফটে উপরে ওঠার সময় হঠাৎ করেই গতি কমে যায় লিফটের। এক ফ্লোর ওপরে উঠতে প্রায় ৪০ সেকেন্ড সময় লাগে। আতঙ্কে তার সঙ্গে থাকা আরও সাতজন ২য় তলায় নেমে যান।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির শাহ মো. মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহানগর দায়রা জজ আদালতে জনসাধারণের জন্য দুইটি লিফট রয়েছে। এর মধ্যে একটি মাঝেমধ্যে নষ্ট হলে আমরা গণপূর্তের এখানে যারা আছে তাদের ফোন দিয়ে জানাই। তারা এসে ঠিক করে দিয়ে যান। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে লিফটের ভেতরে কেউ আটকা পড়লে তাদের উদ্ধারে লিফট সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়।
লিফট সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে আমাদের এখানে তেমন কিছু করার নেই। আমরা তাদেরকে সমস্যার কথা জানিয়ে বারবার তাগাদা দিয়েছি। এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবেন।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির মো. খাদেমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিফটসহ ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। লিফটের বিষয়ে প্রতিনিয়ত আইনজীবীরা আমাদের অভিযোগ জানান। জেলা জজ পুরান ভবনে দুইটি ও নতুন ভবনে একটি লিফট অচল হয়ে আছে। সম্প্রতি বিজ্ঞ জেলা জজ গণপূর্তের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং লিফটের বিষয়ে তাগাদা দিয়েছেন। আশা করছি খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হবে।
গণপূর্তের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওঠানামা করায় লিফট এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। প্রচণ্ড গরমে নিরবচ্ছিন্ন ও একই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় লিফটের সেন্সর ঠিকমতো কাজ করে না। আমরা প্রত্যেকটা লিফটের দেখভাল করার জন্য জনবল নিয়োগ করেছি।
সম্প্রতি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৩য় লিফটের কন্ট্রোল প্যানেল বদলানো হয়েছে। বাকি দুই লিফটে যেহেতু সমস্যা হচ্ছে খুব দ্রুতই আমরা কন্ট্রোল প্যানেল বদলানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের অচল তিন লিফট সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা গত অর্থবছরে লিফটের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছি তবে কোনো বাজেট পাস হয়নি। এ অর্থবছরে নতুন করে আবার চাহিদাপত্র দেব। বাজেট পাওয়া মাত্র আমরা নতুন লিফট বসানোর পদক্ষেপ নেব।
ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রহমান হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনজীবীদের স্বার্থ রক্ষার আমরা সদা তৎপর রয়েছি। আদালতগুলোতে লিফট সংকট অনেকদিন থেকেই। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের তুলনায় লিফটের সংখ্যা অনেক কম। এর মধ্যে আবার অনেকগুলোই নষ্ট। আমি এই ঈদে আইনমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে নষ্ট লিফট ঠিক করাসহ আদালতের ভবনগুলোতে অতিরিক্ত আরও ৯টি লিফট বরাদ্দ করার জন্য মৌখিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি এই বরাদ্দ দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি নষ্ট লিফটগুলো মেরামত ও নতুন লিফটগুলো বসানো হলে মানুষের ভোগান্তি অনেকটাই লাঘব হবে।