ঘটনাটি ২০২২ সালের ১৮ মার্চের। এদিন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ও প্রসেস বিভাগের ছাত্র মিজানুর রহমান পলাশের ঝুলন্ত মরদেহ ছাত্রাবাস উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় পলাশের পরিবার ছাত্রাবাসের মালিক রেজাউল ইসলাম সরকার ও তার আট সহপাঠীর বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে পলাশ আত্মহত্যা করেছেন। এর আগেও প্রাথমিক তদন্ত ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পুলিশ বলেছিল, বান্ধবীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে পলাশ আত্মহত্যা করেছেন। তবে পলাশের আত্মহত্যার বিষয়টি মানতে নারাজ পরিবার। পরিবার বলছে, ল্যাবের গবেষণা নিয়ে ঝামেলার জেরে সহপাঠীরা পলাশকে হত্যা করেছে।
পলাশ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাঁশেরহাট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রেজাউল ইসলাম সরকারের ব্লুমুন ছাত্রাবাস থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আবদুস সাত্তার ছেলে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পলাশের সঙ্গে আমেনা খাতুন আন্নি নামের এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাদের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হলে উভয়ের পরিবারের সঙ্গে পলাশ ও আমেনার বিয়ের কথা বার্তা ঠিক হয়। তবে পলাশের মা হাছিনা পারভিন পলাশকে পড়ালেখা শেষ করে বিয়ের পরামর্শ দেন। এমতাবস্থায় পলাশ ওই ছাত্রাবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা করতে থাকে এবং আমেনার সঙ্গে মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারে নিয়মিত কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে আমেনা পলাশকে বিয়ের জন্য চাপ দেন। পলাশ লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু আমেনা লেখাপড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না বলে পলাশকে জানায়। ঘটনার দিন রাত ১২ টা ১০ মিনিটের দিকে ব্লুমুন ছাত্রাবাসের মালিক রেজাউল ইসলামকে পলাশের ফেসবুক আইডি থেকে ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়ে আমেনা খাতুন ফোন করে জানান যে, পলাশকে আমিসহ তার বাড়ি থেকে ফোন দিচ্ছে সে ফোন ধরছে না। তাকে একটু ডেকে দেবেন। পরে ছাত্রাবাসের মালিক রেজাউল, পলাশের পাশের কক্ষের ছাত্র তানজিদ উল আলম প্লাবনকে ফোন দিয়ে পলাশকে ডেকে দিতে বলেন। রাত ১২ টা ১৬ মিনিটের দিকে প্লাবন পলাশকে ডাকতে গিয়ে রুমের ভেতর থেকে কোনো সাড়াসব্দ না পেয়ে পাশের কক্ষের আসাদুজ্জামান রিয়ানকে ডাকে। পরে দুজন মিলে পলাশকে ডাকতে থাকে এবং দরজায় ধাক্কা ও ডাকাডাকির শব্দে শামস আল শাফিন সিমান্ত ও নাফিজ ফুয়াদ লাবিব ওই কক্ষের সামনে আসে। এরপর চারজন মিলে পলাশকে ডাকাডাকি ও দরজায় ধাক্কাতে থাকে আনুমানিক ১ থেকে ২ মিনিট পরে দর্জা খুলে গেলে পলাশকে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলে থাকা অবস্থায় দেখতে পেয়ে তারা চিৎকার করে। পরে ছাত্রাবাসের মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি অবগত করে। পরবর্তীতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ওই কক্ষে প্রবেশ করে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে পলাশ আত্মহত্যা করেছে মতামত প্রদান করেছেন দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডাক্তার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।এদিকে এ ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে পলাশ তার গাজীপুরের বাসায় যান। সেখানে তিনি একদিন অবস্থান করে একটি সাদা কাগজে তার ছাত্রাবাসের নাম-ঠিকানা, মালিকের নাম ও নিজ ব্যবহৃত সিমের বিকাশ ও রকেট নাম্বারের পিন নাম্বার লিখে নিজ টেবিলের ড্রয়ারে না রেখে তার বোন সাবিনা ইয়াসমিনের টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিনাজপুরের ব্লুমুন ছাত্রাবাসে ফিরে আসেন। এছাড়া তদন্তে পিবিআই আরও পেয়েছে যে পলাশ একাই এক কক্ষে থাকতো। কানে হেড ফোন দিয়ে অধিকাংশ সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতো। আমেনার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের বিষয়টি নিয়ে একাকি বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরে পলাশ। এক পর্যায়ে মনমরা ভাবে চলাফেরা শুরু করে। তার বন্ধুসহ ছাত্রবাসের অন্যান্য ছাত্ররা তাকে সবসময় মন খারাপ এ চুপচাপ থাকার কারণ জানতে চাইলে সে উত্তরে জানায়, প্রেম ও বিয়ের বিষয়টি নিয়ে সে খুবই চিন্তিত। তার শরীরের বাম হাতে পুরাতন কাটা দাগের চিহ্ন ছিল যা সে নিজে নিজেই করতো। এছাড়াও সে তার পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট করা নিয়ে বেশ চিন্তা করতো।
পলাশের বাবা আবদুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার দিন রাতে পুলিশ পরিচয়ে ফোন করে জানানো হয়, পলাশের অবস্থা ভালো না। দ্রুত দিনাজপুর হাসপাতালে যেতে বলে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে পলাশের মরদেহ দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মামুনুর রশিদ ও ছাত্রাবাসের মালিক রেজাউল ইসলাম আমাকে জানান পলাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে ছবি সংগ্রহ করে দেখা যায়, মিজানুরের এক হাত বাঁধা ছিল। পা মেঝের সঙ্গে অনেকটা বাঁকানো ছিল। আত্মহত্যা করলে গলায় যে ধরনের দাগ থাকার কথা, তেমন দাগও ছিল না। কিন্তু হাতে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ছাত্রাবাসের মালিক সিসিটিভি ফুটেজ দিয়েও সহযোগিতা করেনি। এ কারণে আদালতে হত্যা মামলা করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনেও আসামিদের নির্দোষ দাবি করেছে পুলিশ। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ব্লুমুন ছাত্রাবাসের মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রেজাউল ইসলাম সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পলাশকে যেদিন ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পুলিশ উদ্ধার করে সেদিন ছিল শবে কদরের রাত। আমি সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আমার বাসায় অবস্থান করছিলাম। রাত ১২ টার দিকে আমার কাছে ম্যাসেঞ্জারে একটা ফোন আসে। আমি রিসিভ করলে একটি মেয়ে বলে আঙ্কেল আপনার মেসে যে পলাশ থাকে তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না আপনি একটু দেখেন। আমি তার কথা শুনে পলাশের পাশে রুমে যে থাকে তাকে বললাম দেখো তো পলাশ কেন ফোন ধরছে না। তার কিছুক্ষণ পরে ছাত্রাবাস থেকে এক ছাত্র আমাকে ফোনে জানায় পলাশের রুম আটকানো। ভেতরে লাইট জ্বলে ডাকলে শুনে না। তখন আমি বলি জোরে জোরে গেটে ধাক্কা দেও তাহলে ও বুঝতে পারবে, সে হেডফোন লাগিয়ে রাখে কানে সবসময়। এর কিছুক্ষণ পরে ছাত্রাবাস থেকে আমাকে জানানো হয় পলাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। আমি সাথে সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ভিসি স্যারকে অবগত করি তখন তারা পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে তার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তার পরিবার আমাকে প্রধান আসামি করে আমার নামে মামলা করেছে। আমি বাসায় থেকেও মামলার আসামি হলাম। পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও সে আত্মহত্যা করেছে।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মামুনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র পলাশের ঝুলন্ত মরদেহ ছাত্রাবাস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তখন আমরা জানতে পেরেছিলাম এক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে সে আত্মহত্যা করে। পরে তার পরিবার ব্লুমুন ছাত্রাবাসের মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রেজাউলকে প্রধান আসামি করে ৯ জনের নামে মামলা করেছে। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাভোকেট নিয়ামুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ মামলাটি ভালোভাবে তদন্ত করেনি। পুলিশ যা রিপোর্ট দিয়েছে পিবিআইও একই রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা এটা না রাজি করেছি। এটার শুনানি আগামী ৭ জুলাই রয়েছে।
দিনাজপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর এসআই মো. রোকনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এক বছরের মতো সময় নিয়ে তদন্ত করে যা পেয়েছি তা সুন্দরভাবে রিপোর্ট করে জমা দিয়েছি। আমার তদন্তের সময় আমাকে কেউ কোনো রকম প্রেসার দেয়নি বা বাদী-বিবাদী আমার কোনো আত্মীয় স্বজনও না।
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তে মামলার আসামিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।