কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী। কয়েকদিনের বিক্ষোভ-সংঘর্ষ-সহিংসতায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এ এলাকা। প্রাণহানি ঘটে অনেকের।
আন্দোলন চলাকালে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় দুই পুলিশ সদস্যকে আটক করেন বিএনপি, ছাত্রদল ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা। পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয় রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজে। এর মধ্যে নায়েক গিয়াস উদ্দিনকে গত ১৯ জুলাই ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোহাম্মদ মুক্তাদিরকে ২০ জুলাই হত্যা করা হয়।দুটি ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলায় সাতজনকে গ্রেফতার করে ছয়জনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মুক্তাদির হত্যা মামলায় কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি।
এএসআই মুক্তাদির নিহতের ঘটনায় স্ত্রীর হত্যা মামলা
এএসআই মোহাম্মদ মুক্তাদিরকে (৫০) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী মনিরা আক্তার বাদী হয়ে গত ২৪ জুলাই হত্যা মামলা করেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ নবীউল্লাহ নবীসহ ১৭ জনের নাম এজাহারভুক্ত করে অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে মামলায় আসামি করা হয়। মামলার পর ২৫ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক এজাহার গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।
মুক্তাদিরকে হত্যার পর পোড়ানোর চেষ্টা
মুক্তাদির হত্যা মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘গত ২০ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আমার স্বামী তোপখানা রোডে ট্যুরিস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ডিউটি পালনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। যাত্রাবাড়ী থানাধীন রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজের সামনে আসামাত্রই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে যে কোনো সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চান। ওই সময় পূর্বপরিকল্পিতভাবে নবী উল্লাহ নবীসহ এজাহারনামীয় ১৭ জন এবং আরও অজ্ঞাতনামা আসামিরা আমার স্বামীর পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দেশে নাশকতা সৃষ্টির অংশ হিসেবে আটক করেন। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুরুতর জখম করেন।’
‘আমার স্বামী ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় আসামিরা লোহার রড, লাঠি দিয়ে তার দুই হাত, বুক, পেট, পিঠ, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ঘটনাস্থলে নির্মমভাবে হত্যা করে রশি দিয়ে ফুটওভার ব্রিজের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর মরদেহ নিয়ে আসামিরা পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠেন। মরদেহ গুম করার লক্ষ্যে উলঙ্গ করে আগুন লাগিয়ে পোড়ানোর চেষ্টা করেন। পরে রাস্তার পাশে মরদেহ ফেলে রেখে যান তারা।’
গিয়াস হত্যায় বিএনপির নয়নসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
পুলিশ সদস্য গিয়াস উদ্দিন হত্যার ঘটনায় গত ২৪ জুলাই তার ভগ্নিপতি ফজল প্রধান বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম নয়নসহ ১৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে আসামি করা হয়। গত ২৫ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক মামলার এজাহার গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।
গিয়াসকে হত্যার পর রশি দিয়ে ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখে
গিয়াস হত্যা মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ পুলিশের নায়েক গিয়াস উদ্দিন (৫৮) পরিবারসহ মাতুয়াইল মাতৃসদন হাসপাতালের বিপরীত পাশে ভাড়াবাসায় থাকতেন। গত ১৯ জুলাই রাত আনুমানিক ৯টায় গণভবনে সরকারি ডিউটি পালনের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে বাসা থেকে বের হন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজের উত্তর পাশে আসামাত্র উল্লেখিত আসামিরাসহ অজ্ঞাতনামা আরও অনেকে পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত হয়ে গিয়াস উদ্দিনকে আটক করেন।
এরপর তাকে ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুরুতর আঘাতসহ রক্তাক্ত জখম করেন। পরে রাস্তায় পড়ে গেলে আসামিরা লোহার রড, লাঠি দিয়ে গিয়াস উদ্দিনের নাক, কান, মুখমণ্ডল, গলা, হাত, বুক, পেট, ডান পায়ের হাঁটুর নিচেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এরপর তাকে রশি দিয়ে ফুটওভার ব্রিজের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
গিয়াস হত্যা মামলায় ৭ জন গ্রেফতার
গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলায় ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানা, দনিয়া ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. এরফান ওরফে রোকন, ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য মো. আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, মো. সৌরভ মিয়া, মো. তারেক হোসেন ও ঢাকা কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৭ জুলাই তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ফাইয়াজের আইনজীবী তাকে শিশু দাবি করে রিমান্ড বাতিল এবং মামলাটি শিশু আদালতে পাঠানোর আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শান্তা আক্তারের আদালত ফাইয়াজসহ সাত আসামির সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে শিশু ফাইয়াজকে রিমান্ডে নেওয়া ও তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পুলিশ ভ্যানে তোলার ঘটনায় পরদিন ২৮ জুলাই জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকার ও বিচারপতি মো. মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ফাইয়াজকে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেন। আদালত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদকে সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে ফাইয়াজের বাবা-মাকে খুঁজে বের করে তার জামিনের বিষয়ে দরখাস্ত দাখিল করতে বলেন।
একই দিন (২৮ জুলাই) ফাইয়াজকে শিশু হিসেবে দাবির স্বপক্ষে বয়স প্রমাণক হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা ও জন্মসনদ ঢাকার সিএমএম আদালতে দাখিল করায় তার রিমান্ড স্থগিত করা হয়। সেইসঙ্গে তার বয়স নির্ধারণ বিষয়ে শুনানি ও আদেশের জন্য সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে পাঠানো হয়। শিশু আদালত সেদিনই শুনানি শেষে ফাইয়াজকে শিশু হিসেবে ঘোষণা করে তার রিমান্ড বাতিল করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন।
হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলেন স্বজনরা
নিহত এএসআই মোহাম্মদ মোক্তাদিরের ছেলে মাহফুজ রহমান (১৯) জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার কোনো দোষ ছিল না। আমি হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাই।’
হত্যার বিচার চেয়েছেন নিহত নায়েক গিয়াসের ভগ্নিপতি ফজল প্রধানও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গিয়াস তার দায়িত্ব পালনের জন্য রায়েরবাগ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার গায়ে ইউনিফর্ম ছিল না। সেখানে ডিউটিও ছিল না তার। তার মোটরসাইকেলে পুলিশ লেখা ও রেশন কার্ড দেখে তাকে পুলিশ হিসেবে শনাক্ত করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা এখন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। তাকে নৃশংসভাবে যারা রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করেছে, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, এটাই আমাদের চাওয়া।’তদন্ত অব্যাহত আছে
ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের উপকমিশনার শাহেদ আল মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশ সদস্য গিয়াস হত্যা মামলায় কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাসুদ রানা নামের এক আসামি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জড়িত আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।’