চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার জেলা প্রশাসকের নাম ভাঙ্গিয়ে অর্রে বিনিময়ে বছরব্যাপী ছাত্রী ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি ফান্ডের র্অ লুটপাট, অতিরিক্ত ফি আদায়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য সহ ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক গঠিত ২ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির সরেজমনি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
গত ২১ আগষ্ট ২০২৩ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান স্বাক্ষরিত অভিযোগনামায় উল্লেখ করেন, যেহেতু, আপনি জনাব উত্তম কুমার সাহা, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর, বর্তমানে প্রধান শিক্ষক, লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, লক্ষ্মীপুর এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন হতে ১০ টি অভিযোগ সম্বলিত একটি অভিযোগনামা এবং উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক সরেজমিন তদন্ত করার জন্য ০২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের মধ্যে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ১০১ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা, বিদ্যালয়ের পিডিএস ফাইলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হালনাগাদ না করা, কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা, বিজ্ঞানাগারের মালামাল ক্রয়ে আপনার নিজের মতো করে বিল ভাউচার তৈরি করা এবং কিছু কিছু মালামাল ক্রয় করে শিক্ষকদেরকে পুরোপুরি মালামাল বুঝিয়ে না দেওয়া, লিভারিজ খাতের বরাদ্দকৃত টাকা কর্মচারীদের বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে;
যেহেতু, প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আপনার উক্তরূপ কার্যকলাপ আচরণ বিধি পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি মোতাবেক “অসদাচরণ” এর পর্যায়ভূক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ; সেহেতু, উপর্যুক্ত অপরাধে আপনাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি মোতাবেক “অসদাচরণ” এর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো। একই বিধিমালার ৪ (৩) (ঘ) বিধি অনুযায়ী কেন আপনার উপর “চাকরি হতে বরখাস্তকরণ” অথবা অন্য কোন উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করা হবে না তা এ অভিযোগনামা প্রাপ্তির ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানানোর জন্য বলা হলো। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনি ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন কিনা তাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লিখিতভাবে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। যে অভিযোগ বিবরণীর উপর ভিত্তি করে এ অভিযোগনামা প্রণীত হয়েছে তা এ সাথে সংযুক্ত করা হলো।
এখানে উল্লেখ্য, একটি অভিযোগের সূত্র ধরে ২৬ অক্টোবর ২০১৫ দৈনিক মেঘনাবার্তায় ‘দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহা, জেলা প্রশাসকের নাম ভাঙ্গিয়ে মাতৃপীঠ উবিতে বছরব্যাপী ভর্তি বাণিজ্য’ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়। পুরো জেলা জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওই সংবাদে জেলা প্রশাসনেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। প্রকাশিত সংবাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ২ নভেম্বর ’১৫ জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মণ্ডল তদন্তপূর্বক মতামতসহ জরুরী ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার উদয়ন দেওয়ানকে নির্দেশ দেন।
নির্দেশিত হয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার উদয়ন দেওয়ান ১৭ নভেম্বর সরেজমিন তদন্ত করবে মর্মে মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে নোটিশ পাঠান। অনিবার্য কারণে ওই নির্ধারিত তারিখে তদন্ত না হলেও জেলা প্রশাসকের নির্দেশনার ঠিক এক মাস পর ২ ডিসেম্বর ’১৫ জরুরী ওই তদন্তর কাজ শুরু করেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার। সকাল ১০ টায় তদন্ত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ১১ টায় শুরু হয়ে চলে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। তদন্ত কর্মকর্তা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেন প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহার জন্য। তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকায় তদন্ত শুরু করতে বিলম্ব হওয়ায় ওই সময়ে বার বার ছাত্রীদের হাজিরা খাতা চাইছিলেন।
এ সময় তদন্ত কর্মকর্তাকে তা দেখাতে ব্যর্থ হন অন্যান্য শিক্ষকরা। জানতে চাইলে শিক্ষকরা তাকে বলেন, হাজিরা খাতা প্রধান শিক্ষক আলমিরায় তালা দিয়ে রাখেন, তাই উনি না এলে সেগুলো পাওয়া সম্ভব নয়।
সারা বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কক্ষে টেবিলের ওপর পড়ে থাকে ছাত্র/ছাত্রীদের হাজিরা খাতা। শুধু ব্যতিক্রম মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। কেবল এই বিষয়টি সামনে নিয়ে তদন্তে অগ্রসর হলেই বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।
তদন্তের প্রম দিনে দুর্নীতির মাধ্যমে ‘বছরব্যাপী ছাত্রী ভর্তির’ প্রমান মিলেছে। র্৪ শ্রেণির ছাত্রীদের হাজিরা খাতানুযায়ী জানুয়ারি মাসে প্রভাতি শাখায় ৬৩ জনের নাম পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিমাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে অক্টোবর মাসে ৭৯ জনে ঠেকে। দিবা শাখায় জানুয়ারিতে ৫৭ জন দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়ে অক্টোবরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০ জনে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির প্রভাতি ও দিবা’র ৪টি শাখার অবস্থাও একই। সারা বছর জুড়ে অবৈধভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে যে ৭৬ জন ছাত্রী তিনি ভর্তি করেছেন তার স্বপক্ষে জেলা প্রশাসকের অনুমতির দালিলিক প্রমান উপস্থাপন করতে পুরো পুরি র্ব্য হন। র্৪ এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি ছাড়া মাতৃপীঠে অন্য কোন শ্রেণিতে সবাসরি ভর্তির সুযোগ না াকলেও সরকারি প্রজ্ঞাপন অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তিনি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে এটি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ। এ ছাড়া জেলা শহরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া একজন শির্ক্ষাীও ভর্তির কোন ক্ষমতা বা সুযোগ প্রধান শিক্ষকের নেই।
উত্তম কুমার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন নানা তদবির আর চাপে নাকি তিনি ওই অবৈধ পথে হেঁটেছেন। অভিভাবকরা প্রশ্ন করেছেন, এই চাপ কি শুধু মাতৃপীঠের জন্য ? হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রও কেন অবৈধভাবে ভর্তি করতে হলো না ?
উত্তম কুমার দুর্নীতির দায় েেক বাঁচতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ম্যিাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি তার ভর্তি বাণিজ্যকে হালাল করতে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের মেয়েকে অনুরোধে ভর্তি করেছেন বলে দাবি করেন। অথচ ওই সম্পাদকের মেয়ে ২০১০ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নিজ যোগ্যতায় ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। উত্তম কুমার ওই সময় প্রধান শিক্ষক কিংবা চাঁদপুরেই ছিলেন না। এইভাবে নানান মিথ্যাচার এবং চরিত্র হননের মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনিয়র সরকারি প্রাশসনিক কর্মকর্তাকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালান।
Discussion about this post